Skip to main content

নজরুলের প্রতি সুভাষ লেখক: সুমন্ত ঘোষ


কাজী নজরুল ইসলাম ও সুভাষচন্দ্র বসু উভয়ই যেন বিদ্রোহের অপর নাম। বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কবিতা  ও গান সুভাষচন্দ্রকে শিহরিত, পুলকিত, রোমাঞ্চিত করতো। সেই প্রাণমাতানো গানের যুগে যখন ওভারটুন হল, রামমোহন লাইব্রেরি ও ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে একাধিক চ্যারেটি কনসার্টে কবি নজরুল স্বকন্ঠে গান গেয়েছিলেন দেশবন্ধু ও সুভাষের উপস্থিতিতে। নজরুলের একটি গান "শিখল  পড়ার ছল" শুনে সুভাষ নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি সেদিন, দেশপ্রেমের বলে নিজেকে আরো বলিয়ান করেছিলেন তিনি; আর দেশবন্ধু! তারও চোখ ছলছল করে উঠেছিল মুহূর্তে। লেখক সুমিত মুখোপাধ্যায় তাই তার প্রবন্ধতে বলেছেন, গানটির মধ্যে কেবল বাংলায় সুপ্তোত্থিত যুবশক্তির অন্তর্বহ্নি প্রজ্জ্বলনের আহ্বান নয়, সুভাষের নিজের ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে। নজরুলের একটি কবিতা "সব্যসাচী" সেখানেও যেন আমরা সুভাষের ছায়া পেয়ে থাকি ছত্রে ছত্রে, তিনিই ছিলেন 'যুগশস্ত্রপানী', যিনি এসেছেন নবীনদের দীক্ষা দিতে ও ভারতমাতাকে মুক্ত করতে। আবার শরৎচন্দ্র এর উপন্যাস পথের দাবী তেও "মুক্তির অগ্রদূত"  হিসেবে তিনি যেন সুভাষকেই বেছে নিয়েছিলেন।

সালটা ছিল ১৯২৯ এর ১লা ডিসেম্বর যেদিন কবি নজরুলের জন্য এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেদিনই সুভাষচন্দ্র এক ভাষণে তার নজরুলপ্রীতির কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, 'আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু নজরুলের দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মতো প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।' দেশপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া সুভাষ যখন বিদোহী কবি নজরুলের কণ্ঠ হতে স্বদেশীদের প্রতি বিদেশিদের নিষ্ঠুরতার পরিচয়বাহী গান শুনতেন তখন তার মন যেন বিচলিত হয়ে উঠতো; তার এই বিচলিত স্বদেশ প্রেমি চিত্তের এক প্রাণময় বর্ণনা দিয়েছেন দিলীপকুমার রায়। তিনি বলেছিলেন, 'ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান' স্ববকটি যখন নজরুল গাইতেন তখন সুভাষের মুখ আবেগে রাঙা হয়ে উঠতো।

স্বদেশী যুগের কবি ও সাহিত্যিকদের অবদান সম্পর্কে সুভাষ ছিলেন সবিশেষ কৃতজ্ঞ। সমাজে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদকে সুভাষ কোনোদিন প্রশ্রয় দিতেন না। সুভাষের মনে হত একজাতির মানুষ অন্য জাতিকে ঘৃণা, অবজ্ঞা করলে কোনোদিনও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না, যার ফলে একটা বৈষম্য দেখা দিতে বাধ্য। আর তাই একসময় নজরুলের 'জাতির নামে বজ্জাতি সব' গানটি সুভাষের হৃদয়ে দোলা দিয়েছিল। সুভাষের মনের ভাবকেই যেন নজরুল প্রস্ফুটিত করেছিলেন, যখন বলেছিলেন- আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান, দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারি হুঁশিয়ার।

বদ্ধ ঘরে কে থাকতে চায়? আর সেক্ষেত্রে যদি সুভাষের প্রশ্ন ওঠে! তাকে যে স্থির বা বদ্ধ করে রাখা যেন দুঃসাধ্য কার্যসম। তাই বার বার ব্রিটিশদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি নিজ গতিতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, ফলে তাকে জেলে যেতেও হয়েছিল। একদা তিনি দিলীপকুমারকে বলেছিলেন, "ভাই জেলে যখন ওয়ার্ডার লোহার দরজা বন্ধ করে, তখন মনে যে কি আকুলি-বিকুলি করে যে কি বলব? তখন বার বার মনে পড়ে কাজীর ওই গান 'করার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট রক্তজমাট শিকল পূজার পাষান বেদী।" সুভাষ বলতেন, 'আমরা যখন যুদ্ধে যাবো, সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। নজরুলের 'অগ্রপথিক সৈন্যদল, জোর কদম চল রে চল' গানটি সুভাষের আজাদ হিন্দ ফৌজের 'কদম কদম বাড়ায়ে যা' গানটির সঙ্গে সমতুল্য।

তাই বলা যায়, সুভাষকে 'নেতাজি' করতে কবি নজরুলের গান ও কবিতার মাধ্যমে পরোক্ষ সহযোগিতা কোনোদিনই উপেক্ষণীয় বিষয় বস্তুতে পরিণত হবে না। আজ তারই দৃষ্টান্ত হিসেবে আমার এই ছোট্ট প্রবন্ধটির উপস্থাপনা। শক্তির প্রকাশ/উৎস হতে শক্তি সঞ্চয়ে সদাব্যস্ত দেশপ্রেমী সুভাষচন্দ্র নজরুলের সংগীত ও কবিতাকেও শক্তি সঞ্চয়ের দুটি মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন, আর সেই অর্জিত শক্তিকে তিনি ব্রিটিশদের দেশছাড়া করে ভারতমাতার শেকলবদ্ধ পা শেকলমুক্ত করতে চেয়েছিলেন।

সুত্রনির্দেশ:
১) সুমিত মুখোপাধ্যায়, সুভাষচন্দ্রের জীবনে কাব্য ও সঙ্গীতের প্রভাব, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ
২) Ibid
৩) Ibid
৪) Ibid, এখানে উল্লেখিত দিলীপকুমার রায়ের বক্তব্য
৫) Ibid
৬) Ibid , এখানে উল্লেখিত দিলীপকুমার রায়কে বলা সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য
৭) Ibid



Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...