Skip to main content

দেওপাড়া প্রশস্তি লেখক: আকসাদুল আলম

দেওপাড়া প্রশস্তি প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ লিপিতাত্ত্বিক উৎস। লিপিটিতে কিছু অতিপ্রশংসাসূচক শ্লোক রয়েছে যেগুলি সেন রাজবংশ বিশেষত বিজয়সেনের ইতিহাসের উপর গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করে। সেন যুগের বিখ্যাত সংস্কৃত কবি এবং লক্ষ্মণসেন এর মন্ত্রী উমাপতিধর এ প্রশস্তিলিপি রচনা করেছেন।
একটি প্রস্তর খন্ডের উপর খোদিত এ লিপি রাজশাহী জেলা শহর থেকে ৫ কি.মি. পশ্চিমে গোদাগাড়ি পুলিশ স্টেশনের অধীন দেওপাড়া নামক গ্রাম থেকে ১৮৬৫ সালে সি.টি মেটকাফ আবিষ্কার করেন। লিপিটির প্রাপ্তিস্থানের আশেপাশে দিঘাপতিয়ার কুমার শরৎ কুমার রায় এর নেতৃত্বে পরিচালিত উৎখননের ফলে বিস্তৃত এক অঞ্চল, যেখানে রয়েছে পাথুরে নিদর্শনাদি, পুরানো দিঘি এবং প্রাচীন বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ (উদাহরণস্বরূপ জাঁকজমকপূর্ণ প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দির) আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান লিপিটি পদুশ্বর নামে পরিচিত একটি বড় দিঘির পাড়ে দেখা যায়। ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে সেন রাজাদের রাজধানী হিসেবে উল্লিখিত বিজয়পুরকে দেওপাড়া গ্রামের দক্ষিণে অবস্থিত বিজয়নগর গ্রামের সঙ্গে পন্ডিতগণ অভিন্ন বলে শনাক্ত করেন।
জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (সংখ্যা-৩৪, পার্ট-১) পত্রিকায় মেটকাফ সর্বপ্রথম শিলালিপিটি প্রকাশ করেন। পরে ইপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকার প্রথম খন্ডে প্রফেসর কীলহর্ণ লিপিটি সমালোচনার দৃষ্টিতে সম্পাদনা করেন।
লিপিটিতে সমান দৈর্ঘ্যের ৩২টি লাইন রয়েছে। যে পাথরের উপর লিপিটি খোদিত সেটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ০.৯৭ মি/ ০.৬ মি কিন্তু খোদিত অংশের পরিমাণ ০.৮২ মি / ০.৪৫ মি। অক্ষরের আয়তন মোটামুটিভাবে ৩/´´। অপূর্ব দক্ষতা ও গভীর যত্নের সঙ্গে খোদাইকারী এটির কাজ সম্পন্ন করেন।
শিলালিপিটিতে রাজা বিজয়সেনের রাজত্বকাল এবং বাংলার সেন রাজাদের বংশতালিকা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ৫-৯ নং শ্লোকে সেনগণ দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট হতে উদ্ভূত এবং ব্রহ্মক্ষত্রিয় হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। ১৪-২২ নং শ্লোক বিজয়সেন চিত্রিত হয়েছেন প্রাচীন যুগের একজন মহান রাজা বা বিখ্যাত রাজা হিসেবে। এ সকল শ্লোক বলা হয়েছে, বিজয়সেন নান্য, বীর, রাঘব, বর্ধন রাজাদেরকে বন্দি এবং গৌড়, কামরূপ ও কলিঙ্গরাজকে পরাজিত করেছেন। পশ্চিমের (‘পাশ্চাত্য চক্র’) রাজাদেরকে পরাস্ত করার জন্য তিনি গঙ্গার গতিপথ ধরে একটি নৌ অভিযানও প্রেরণ করেছিলেন।
বিজয়সেন অতি উচ্চমানের এবং জাঁকজমকপূর্ণ প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দির নির্মাণ করেন এবং এর নিকটে খনন করেন একটি দিঘি (শ্লোক নং ২২-২৯)। লিপিতে এরপর বর্ণিত হয়েছে মন্দিরের অভ্যন্তরে স্থাপিত একটি মূর্তির বিষয়ে (শ্লোক নং ৩০-৩১) এবং সবশেষে রয়েছে প্রশস্তিলিপির রচয়িতা উমাপতিধর এবং খোদাইকারীর পরিচয়।
সম্পূর্ণ লিপিটিতে ৩৬টি শ্লোক রয়েছে যেগুলি নানা ধরনের ছন্দে রচিত যেমন বসন্ততিলকশার্দূলবিক্রীড়িতস্রগ্ধরাপৃথ্বীমন্দাক্রান্তামালিনীশিখরিণীইন্দ্রবজ্রা, এবং উপজাতি। লিপিটিতে ব্যবহূত অক্ষর আদি বাংলা অক্ষরের সঙ্গে অনেকটাই অভিন্ন। দেওপাড়া প্রশস্তিলিপির অক্ষর নিয়ে গবেষণাকারী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, এ সময়ে বলতে গেলে বাংলা বর্ণমালার প্রায় ২২টির ক্ষেত্রেই আকৃতিগত উন্নয়ন সম্পূর্ণ হয়েছিল। এ কারণে, দেওপাড়া প্রশস্তিলিপিটিকে আধুনিক বাংলা বর্ণমালার পূর্বসূরি বলা যেতে পারে।
একথা সত্য যে, দেওপাড়া প্রশস্তিতে সেন রাজা, বিশেষ করে বিজয়সেন সম্পর্কে অতিপ্রশংসামূলক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অতি প্রশংসার এ সুর নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলা বিজয়সেনের অধীনে ইতিহাসে এক গৌরবময় স্থান অর্জন করেছিল।  

গ্রন্থপঞ্জি  NG Majumdar, Inscription of Bengal, Vol III, Rajshahi, 1929; AM Chowdhury, Dynastic History of Bengal, Dhaka, 1967; RC Majumdar, History of Ancient Bengal, Calcutta, 1971

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...