Skip to main content

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার. লেখক: নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য


রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০), শিক্ষাবিদ ও বাঙালি ঐতিহাসিক। তিনি ১৮৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার খন্দরপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। হলধর মজুমদার এবং বিন্দুমুখীর পুত্র রমেশ চন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯০৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯১১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অধীনে রমেশচন্দ্রের ঐতিহাসিক গবেষণা শুরু হয়। ‘অন্ধ্র-কুষাণ কাল’ নামক অভিসন্দর্ভের জন্য ১৯১২ সালে তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১৩ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় এবং ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন।
১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘Corporate life in Ancient India’ শীর্ষক পি-এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করে। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে তিনি নবস্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে Early History of Bengal নামক তাঁর ছোট একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। Outline of Ancient Indian History and Civilization (পরবর্তী নাম Ancient India) প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এ সময়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর জ্ঞান আহরণে উৎসাহী হন। তিনি ফরাসি ও ডাচ্ ভাষা শেখেন এবং ভিয়েতনাম অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর চম্পা (১৯২৭) নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি লন্ডনের British Museum, লেইডেনের Kern Institute এবং প্যারিসের Bibliotheque Nationale-এ পড়াশুনা করেন। অতঃপর তিনি বেলজিয়াম, ইতালি ও জার্মানি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত এলাকা পরিভ্রমণ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ভ্রমণ পরবর্তী সময়ে তাঁকে প্রায় পাঁচটি প্রামাণিক গ্রন্থ রচনায় সহায়তা করেছিল, যেগুলির মধ্যে Suvarnadvipa-র দুটি খন্ড উল্লেখযোগ্য। এসব খন্ডের উপাদানগুলি Hindu Colonies in the Far East গ্রন্থ রচনায় ব্যবহূত হয়েছে। এটি প্রথম ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় এবং এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।
ঢাকায় অবস্থানকালে মজুমদার তিন খন্ডে বাংলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা করেন, যেগুলির মধ্যে প্রাচীনকালের ওপর লেখা প্রথম খন্ড তিনি নিজে সম্পাদনা করেন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পিত হয় স্যার যদুনাথ সরকারের ওপর। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম খন্ডটি প্রকাশ করে। প্রাচীন বাংলার ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার প্রয়াস হিসেবে এটি বিশ্বব্যাপী পন্ডিত মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। ১৯৩৬ সালে রমেশচন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
ভারতীয় বিদ্যাভবন সিরিজের ১১টি খন্ডে রচিত History and Culture of the Indian People ছিল মজুমদারের এক গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি। এই প্রকল্পে ৭৫ জন পন্ডিত কাজ করেন এবং এঁদের অনেকের সবগুলি খন্ড প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই মৃতু হয়।
এ সকল পন্ডিতের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও সিরিজের মোট পৃষ্ঠার অর্ধেকেরও বেশি লিখেছিলেন মজুমদার নিজেই। মূলত প্রাচীন ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও অবস্থার চাপে তাঁকে আধুনিককালের ইতিহাস চর্চায়ও হাত দিতে হয়েছিল। বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের ইতিহাসের উপর গবেষণা করতে হয়েছে এবং প্রায় ৯০০০ পৃষ্ঠা, ২৮৩টি প্লেট ও ২০টি মানচিত্র সম্বলিত ঐ খন্ডগুলি শেষ করতে হয়েছে।
১৯৫০ সালে তিনি ‘ইন্দোলজি কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সেখানে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন এবং এর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে মজুমদার ‘International Commission for a History of the Scientific and Cultural Development of Mankind’-এর সদস্য এবং সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সিরিজের প্রথম গ্রন্থটি পশ্চিমা পন্ডিতদের দ্বারা পরিবেশিত ভুল তথ্যযুক্ত ছিল। তিনি তাঁর বিশেষ টীকা যোগ করে তা সংশোধন করে প্রকাশ করেন।
‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস’ প্রকল্পে মজুমদার ভারতীয় সরকারের সাথে দ্বন্দ্বে উপনীত হয়েছিলেন। এই দ্বন্দ্ব তাঁকে The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857 (one volume, 1957) এবং History of Freedom Movement in India (three volumes, 1962-63) নামক ৪টি বৃহৎ গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৫৫ সালে মজুমদার নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দোলজি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি শিকাগো এবং পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাসের ওপর শিক্ষা দান করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি (১৯৬৬-৬৮) এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১৯৬৮-৬৯)-এর সভাপতি ছিলেন। কিছুকালের জন্য তিনি কলকাতার ‘শেরিফ’ও (Sheriff) ছিলেন।
এইচ.সি রায়চৌধুরী ও কালীকিংকর দত্তের সঙ্গে একত্রে তিনি Advanced History of India গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি ছিল ভারতীয় ইতিহাসের উপর রচিত স্নাতক পর্যায়ের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ্যপুস্তক। তিনি ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ‘endowment lecture’ প্রদান করেন এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নানা ধরনের পুরস্কার লাভ করেন।
৯২ বৎসর কর্মময় জীবন শেষে রমেশচন্দ্র মজুমদারের ১৯৮০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয়। 


(সংগৃহীত)

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...