Skip to main content

কলকাতা-হাওড়া ব্রিজ লেখক: সিরাজুল ইসলাম

উনিশ শতকের সেতু প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অন্যতম নিদর্শন। হাওড়া ব্রিজ নামে বহুল পরিচিত। ১৮৭১ সালে বাংলা সরকারের আইন বিভাগ হাওড়া ব্রিজ আইন পাশ করে (১৮৭১ সালের ৯ নং আইন)। এ আইনে লেফটেন্যান্ট গভর্নরকেকলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে হুগলি নদীর উপর আর্মেনিয়ান ঘাট বা তার আশেপাশে সরকারি অর্থায়নে একটি ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচল ও গমনাগমনের জন্য পথ তৈরি ও সংরক্ষণ এবং নির্দিষ্ট হারে টোল আদায় করার ক্ষমতাও তাঁকে প্রদান করা হয়।প্রখ্যাত ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলের সাথে এই ব্রিজের পরিকল্পনা, নক্সা ও বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়। কারিগরি কারণে ব্রিজের কিছু অংশ ইংল্যান্ডে তৈরি হয় এবং জাহাজে করে কলকাতা নিয়ে এসে তা প্রকল্প স্থানে জুড়ে দেওয়া হয়।


১৮৭৪ সালে সমাপ্ত এ ব্রিজটি তখন পর্যন্ত বাংলা ও ভারতে তৈরি সর্ববৃহৎ ভাসমান অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হতো। নির্মাণের সময় ১৮৭৪ সালের ২০ মার্চের প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে ব্রিজের একটি অংশ বিধ্বস্ত হয়। ঈগেরিয়া নামের একটি স্টিমারের নোঙর ছিঁড়ে ব্রিজের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে এবং ব্রিজের তিনটি পন্টুন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ডুবে যায়। এর ফলে ব্রিজ অবকাঠামোর ২০০ ফুট স্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ পুনর্নির্মাণ করে ১৮৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর ব্রিজটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নক্সা, উপকরণ এবং বাস্তবায়নের অভিনবত্ব ও মৌলিকত্বের জন্য সে সময় ব্রিজটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। ১,৫২৮ ফুট দীর্ঘ এবং ৬২ ফুট প্রশস্ত ব্রিজটির উভয় পার্শ্বে ৭ ফুট প্রশস্ত পায়ে চলার পথ ছিল। আর মাঝখানে ৪৮ ফুট প্রশস্ত পথ ছিল গাড়ি চলাচলের জন্য। ব্রিজটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৬০ লক্ষ রুপি। বর্তমান হাওড়া ব্রিজের প্রায় ১০০ গজ ভাটিতে এই পল্টুন ব্রিজটি অবস্থিত। কলকাতা বন্দর কমিশনাররা ১৮৭৫ সালে ব্রিজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৭৯ সালে আগস্ট মাসে ব্রিজটির মাঝখানে বৈদ্যুতিক খুটি স্থাপন করে। মল্লিকঘাট পাম্পিং স্টেশন থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ দিয়ে ব্রিজ আলোকিতকরণের কাজ সম্পন্ন হয়।

বিশ শতকের প্রথমদিকে ব্রিজ কমিশনারগণ তৎকালীন কলকাতা বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী জন স্কটের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি প্রথমেই একটি নতুন ব্রিজ তৈরির বিষয়ে মনোযোগ দেয়। ১৯২২ সালে বাংলা সরকার নতুন হাওড়া ব্রিজ কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২৬ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজ আইন পাশ হয় এবং কলকাতা বন্দর কমিশনারদের নতুন হাওড়া ব্রিজ কমিশনার হিসেবে ব্রিজ তৈরির কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। নতুন হাওড়া ব্রিজ কমিশনারগণ ক্লিভল্যান্ড ব্রিজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে নতুন ব্রিজ তৈরির কাজ দেয়। ১৯৩৬ সালে ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪২ সালে তা শেষ হয়। ১৯৪৩ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং পুরনো ভাসমান পন্টুন ব্রিজটি প্রয়োজন মতো ব্যবহারের নিমিত্ত সংরক্ষণ করা হয়। নতুন ব্রিজটি তৈরির জন্য ২৬,৫০০ টন স্টিল ব্যবহূত হয় এবং এটি তৈরি করতে আনুমানিক ২০ লক্ষ রুপি ব্যয় হয়।

নতুন হাওড়া ব্রিজ একটি ঝুলন্ত ও ভারসাম্যময় বহির্বাহু সেতু। ব্রিজটি ৭০৫ মিটার লম্বা এবং ৩০ মিটার চওড়া। ব্রিজটির উভয় পার্শ্বে ১৫ ফুট প্রশস্ত পায়ে চলার পথ আছে। যানবাহন চলাচলের পথটি ৭১ ফুট চওড়া।

নতুন হাওড়া ব্রিজটি নির্মাণ জগতের বিস্ময়রূপে চিহ্নিত। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে হাওড়া ব্রিজের নতুন নামকরণ হয় রবীন্দ্র সেতু। প্রতিদিন এই ব্রিজের উপর দিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ যানবাহন এবং সম্ভবত ২ লক্ষাধিক লোক চলাচল করে। হাওড়া ব্রিজ পৃথিবীর সেরা কর্মচঞ্চল অন্যতম। 

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...