Skip to main content

জাদুবিদ্যার জগৎ ও পি. সি. সরকার

জাদুবিদ্যা বা Magic শব্দটি গ্রীক শব্দ Magi থেকে এসেছে। গ্রিক ভাষায় এর মানে হচ্ছে চালাক ব্যক্তি। জাদুবিদ্যা যে এক ধরনের চালাকি, একথা গ্রিকরা জানতেন। অবশ্য সে যুগে এর ব্যবহার হতো সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে অসাধারণ বলে প্রতিপন্ন করতে। যেমন পুরোহিত, ধর্মগুরু বা প্রোফেট এঁদের অনেকে জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করতেন। মন্ত্র দিয়ে বাতাসা তৈরি বা সন্দেশ তৈরি ইত্যাদি সকল কর্মকান্ড সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করত। পৃথিবীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা প্রচারে তথাকথিত লৌকিক জাদুবিদ্যার প্রভাব ছিল অনেকটাই।

তবে আজ বিষয়টা যেন একটু আলাদা আজ সবার জানা, জাদুকর নানা কৌশলে বিশেষ করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কারসাজিতে সবাইকে চমকে দিচ্ছে মাত্র অর্থাৎ চোখের সামনে যা ঘটছে সত্যি করে তা ঘটছে না। জাদুমন্ত্রে একই কাগজ মোমবাতি বা প্রদীপের ওপর ধরলেই সেই কাগজ ফুলে উঠলো--- এটির পেছনে যেমন রসায়নের খেলা তেমনি জাদুকরের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কৌশলে ভরপুর থাকায় আকর্ষণীয় হচ্ছে খেলাগুলি। যদিও জাদু প্রদর্শনীতে বিজ্ঞান প্রযুক্তির সঙ্গে রয়েছে অভিনয় দক্ষতা অনন্য কলা-কৌশল, ইত্যাদি।

অতীত দিনের জাদুবিদ্যা, ভোজবাজি যাই হোক না কেন, আধুনিককালে জাদুবিদ্যা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতিতে বলিয়ান হয়ে বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। বলতে বাধা নেই, গত শতকে পরাধীন ও স্বাধীনতা-উত্তর যুগে যে কজন ভারতীয় সারা বিশ্বে ভারতের মর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করেছেন তাদের অন্যতম হলেন জাদুসম্রাট পি. সি. সরকার। জাদুবিদ্যা দিয়ে বিশ্ব জয় করা যে সম্ভব এটি দেখিয়ে গেছেন বাঙালি জাদুবিদ পি সি সরকার। তার পুরো নাম ছিল প্রতুলচন্দ্র সরকার। জাদুর ইতিহাসে তিনি এক কিংবদন্তিতুল্য পুরুষ। ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল (বৃহত্তর ময়মনসিংহ) জেলার আশেকপুর গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। স্থানীয় শিবনাথ হাইস্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। বাল্যকাল থেকেই জাদুবিদ্যার প্রতি কৌতূহল এবং কিছুটা বংশগত ঐতিহ্যও তাঁকে এ পেশায় আগ্রহী করে তোলে। গণপতি চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর জাদুবিদ্যার গুরু। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তিনি জাদু দেখানো শুরু করেন এবং কলেজে অধ্যয়নকালে পুরোপুরি এর প্রাকটিস শুরু করেন। তবে সাধারণ লেখাপড়া এতে বাধাগ্রস্ত হয়নি। ১৯২৯ সালে প্রবেশিকা এবং ১৯৩৩ সালে গণিতশাস্ত্রে অনার্সসহ বিএ পাস করে তিনি জাদুকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। জাদুজগতে ব্যাপক প্রচারলাভের উদ্দেশ্যে তিনি এক সময় নিজের পদবি ‘সরকার’ বাদ দিয়ে ইংরেজি ‘সোরকার’ (Sorcerer) শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করেন, কারণ শব্দটির অর্থ ‘জাদুকর’। তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণের পর তিনি  আবার নিজের ‘সরকার’ পদবিই গ্রহণ করেন।

পি.সি সরকার শুধু জাদুশিল্পীই ছিলেন না, তিনি একজন লেখকও ছিলেন। জাদুবিদ্যা বিষয়ে ১৯৬৮ সালের পর্যন্ত ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা বিশটি। সেগুলির মধ্যে উলে­খযোগ্য কয়েকটি হলো: দেশে দেশে হিপনোটিজম, ম্যাজিকের কৌশল, ইন্দ্রজাল, SORCAR ON MAGIC, 100 Magic You can do, Hindoo Magic, Magic for You, More Magic for You ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর ছেলেদের ম্যাজিক, সহজ ম্যাজিক, মেসমেরিজম, সম্মোহনবিদ্যা ইত্যাদি গ্রন্থও জাদুবিদ্যার উন্নয়নে উলে­খযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

জাদুশিল্পে পি.সি সরকারের কৃতিত্ব হলো তিনি বহু প্রাচীন জাদুখেলার মূল সূত্র আবিষ্কার করেন। ‘এক্স-রে আই’, ‘করাত দিয়ে মানুষ কাটা’, ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি তাঁর জনপ্রিয় খেলা। ১৯৩৪ সালে তিনি বিদেশ গমন করেন এবং ৭০টির মতো দেশে জাদু প্রদর্শন করে ব্যাপক খ্যাতি ও পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করেন। কলকাতার ইম্পেরিয়াল রেস্টুরেন্টে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হককে যে জাদু দেখিয়ে তিনি মুগ্ধ করেন, তার শিরোনাম ছিল ‘বাংলার মন্ত্রিমন্ডলীর পদত্যাগ’। এ শিরোনামের একটি সাদা কাগজে প্রথমে তিনি ফজলুল হককে কিছু লিখতে বলেন এবং তার নিচে মন্ত্রিগণ স্বাক্ষর করেন। কিছুক্ষণ পরে শেরে বাংলা তাঁর নিজের লেখার পরিবর্তে দেখেন ‘আমরা সম্মতিক্রমে সকলেই এই মুহূর্তে মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করলাম এবং আজ হতে জাদুকর পি.সি সরকারই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।’ এটা ছিল Force writing-এর জাদু। তাঁর জাদু বিভিন্ন দূরদর্শনে যথা অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন, বি.বি.সি, শিকাগোর ডাবলিউ.জি.এন.টি.ভি এবং নিউইয়র্কের এন.বি.সি ও সি.বি.এস টেলিভিশনে বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৫৭ ও ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় এবং ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো ও লেনিনগ্রাদ শহরে জাদু প্রদর্শন করে তিনি বিপুল সুনাম অর্জন করেন। পি.সি সরকারই প্রথম রাজকীয় পোশাক এবং আকর্ষণীয় পাগড়ি পরে জাদু প্রদর্শনের প্রচলন করেন।

চীনের এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি দাবি করেছিলেন তাকে যে কোন হ্যান্ডকাপ দিয়ে রেল লাইনের সঙ্গে বন্দি করে রাখলে ট্রেন আসার পূর্ব মুহূর্তে তিনি চাবি ছাড়াই নিজেকে মুক্ত করে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসবেন! কথাটি শুনে সেদিন সবাই চমকে উঠেছিল। চীনের ক্যান্টন-কাউলুন দুরন্ত গতির এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে থেকে মুক্তির ম্যাজিক দেখিয়ে পি. সু. সরকার ঐ দেশে এক অবিস্মরনীয় রেকর্ড গড়লেন এবং সারা বিশ্বে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেন।

জাদু দেখিয়ে পি.সি সরকার দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেজ ম্যাজিকের জন্য আমেরিকার জাদুবিদ্যার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ‘দি ফিনিক্স অ্যাওয়ার্ড’ তিনি দুবার লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘গোল্ডবার’ পুরস্কার, ‘সুবর্ণ লরেল মালা’ নামে জাদুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জার্মান পুরস্কার, হল্যান্ডের ‘ট্রিক্স পুরস্কার’ এবং ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি লাভ করেন। জাদুখেলার কৃতিত্বের জন্য মায়ানমারের (বার্মার) প্রধানমন্ত্রী থাকিন নু তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘এশিয়ার গৌরব’।

পি.সি সরকার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে ১৯৩৭ সালে জাপান সফরের সব অর্থ দান করেন। তিনি ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মান, বেলজিয়াম এবং জাপানে ম্যাজিশিয়ান সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক রোটারি ক্লাবের সদস্য এবং বিলেতের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্য ছিলেন। তাঁর নামে আমেরিকার ‘আন্তর্জাতিক জাদুকর ভ্রাতৃসংস্থার’ কলকাতা শাখার নামকরণ করা হয়। ইউরোপের বিখ্যাত লেখকরা তাঁর ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে SORCAR: Maha Raja of Magic গ্রন্থটি উলে­খযোগ্য।

পি.সি সরকার জাদুর প্রতি এতই আন্তরিক ছিলেন যে ‘জাদু’ শব্দটিকে তিনি তাঁর বিভিন্ন বাড়ির নামকরণেও ব্যবহার করেছেন। যেমন: ‘ইন্দ্রজাল’, ‘জাদুমহল’ এবং ‘জাদুভবন’ (টাঙ্গাইলে অবস্থিত)। তাঁর জাদুবিদ্যার ওপর রঙিন চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফিক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৯৬৩ সালে নিখিল ভারত জাদু সম্মেলন প্রকাশ করেছে ‘TW’s GM = The Great Sorcar’ নামে একটি ফটোগ্রাফিক অ্যালবাম। হিজ মাস্টারস ভয়েস বের করেছে একটি লংপে­য়িং রেকর্ড। জাদুশিল্পে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য বিশ্ববাসীর কাছ থেকে তিনি ‘জাদুসম্রাট’ ও সর্বকালের ‘শ্রেষ্ঠ সম্রাট’ উপাধি লাভ করেন। তাঁর পুত্র পি.সি সরকার জুনিয়রও একজন বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ৬ জানুয়ারি প্রতুলচন্দ্র সরকার বা পি. সি. সরকার যেন নাটকীয়ভাবেই চলে গেলেন। তখন তিনি জাপানে। সেখানকার জিগেৎসু শহরে প্রদর্শনী দেখানো শেষ হতেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
(রিমা মন্ডল)

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...