Skip to main content

বিষয়- সুকুমারী ভট্টাচার্য / লেখিকা- রোমিলা থাপার

সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর সমসাময়িক ইন্ডোলজিস্টদের মধ্যে একজন অন্যতম অগ্রগণ্য, যিনি তাঁর বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যানগুলির (Mythology) ওপর এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন। আমি এই ব্যাপারে তাঁর লেখা The Indian Theogony বইটির কথা উল্লেখ করতে চাই, যা আমি মনে করি তাঁর গবেষণার এক নতুন ও সুন্দর উদাহরণ। ইংরেজী ও সংস্কৃত দুই ভাষাতেই তাঁর শিক্ষা এবং ভারতীয় ও ইউরোপীয়ান পৌরাণিক কথাগুলির সম্বন্ধে তাঁর প্রভূত জ্ঞান তাঁকে এই বিষয়ে তুলনামূলক স্টাডি করতে সাহায্য করেছিল।
সুকুমারী ভট্টাচার্য খালি বিভিন্ন সংস্কৃতির পৌরাণিক আখ্যানগুলির পাশাপাশি তুলনা করেই থেমে যান নি, তিনি এর থেকেও দু’পা এগিয়ে গেছেন। তার প্রথমটা হচ্ছে কোন প্রসঙ্গে (context)  আখ্যানটি ঘটেছিল এবং সেটি কি ভাবে সেই প্রসঙ্গের সাথে যুক্ত। প্রসঙ্গটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেটাই পৌরাণিক আখ্যানগুলির আঁতুড় ঘর। এর অর্থ আখ্যানটি বর্তমান আকারে কি ভাবে এলো, তার গভীর নিরীক্ষা। আর অন্যটা হচ্ছে যে পৌরাণিক আখ্যানটি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে কি না, আর হয়ে থাকলে কতটা ও কিভাবে।
তুলনামূলক স্টাডিতে এর অর্থ দুই বা ততোধিক প্রসঙ্গগুলিকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা এবং বিচার করা যে তারা এক এক নিরীক্ষিত সমাজে এক এক রকম কিনা। অথবা এক ধরণের প্রসঙ্গ অনুরূপ পৌরাণিক আখ্যানের জন্ম দিয়েছে কিনা। ইন্ডো-ইউরোপীয়ান ভাষাদের আখ্যানগুলির তুলনামূলক স্টাডিতে কিছু কিছু দেবতা একই রকম থাকেন, কিন্তু  মাঝে মাঝে তাঁদের ব্যবহার এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ভিন্ন ভিন্ন। এটা তুলনামূলক স্টাডিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে যেখানে মিল থাকে সেই জায়গাগুলি বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে মানুষের ধ্যান-ধারণা গুলি ছড়িয়ে পড়ার জন্য (diffusion of ideas) পৌরাণিক আখ্যানগুলির মধ্যে মিল দেখা গেছে।  অন্যরা বলেছেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রসঙ্গগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলে আখ্যানগুলির মধ্যে মিল থাকাই স্বাভাবিক। আবার অন্যরা যুক্তি দেখান যে এক সমষ্টিগত অচেতনতা (collective unconscious) এই ধরণের আখ্যানগুলির পরিবেশ তৈরী করে দেয়। যুক্তি বা ব্যাখ্যা যাই হোক, এটা ঠিক যে পৌরাণিক আখ্যানগুলি ও সমাজের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে।

অনেক বিদ্বজ্জন ইন্ডো-ইউরোপীয়ান ও তুলনামূলক পৌরাণিক আখ্যানের ওপরে কাজ করেছেন, যেমন Stig Wikender, Mircea Eliade এবং Claude Leve-Strauss. সুকুমারী ভট্টাচার্য শেষোক্ত দুজনের কাজ তাার নিজের গবেষণা ও বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করেছেন। পৌরাণিক আখ্যানগুলিকে দেখানো হয়েছে সমাজের মর্মস্থলের অভিজ্ঞতাগুলির অভিক্ষেপ হিসেবে, অথবা সাধারণ ভাবে সামাজিক অনুমান হিসেবে। অন্যরা তর্ক পেড়ে বলেন, ওসব নিছক স্বকপোল-কল্পনা, পুরোপুরি অন্য জগতের গল্প, আর এই কাল্পনিক জগতটা বাস্তবের সাথে ভারসাম্য রাখার জন্য জরুরী। পৌরাণিক আখ্যানগুলি সাধারণত দেবতা ও মানুষদের নিয়েই, যদিও তারা কখনো স্বতন্ত্র স্তরে থাকেন আবার কখনো মিলে-জুলে যান। কখনো দেবতারা মানব সমাজের আদর্শ উদাহরণ, আবার কখনো তাঁদের দেখা যায় মানব সমাজের অযোগ্য কাজ করতে। পরবর্তী ক্ষেত্রে দেবতাদের কাজ-কারবার মানুষের কাজের ও ব্যবহারের সীমারেখা টেনে দেয়।
সুকুমারী ভট্টাচার্য পৌরাণিক আখ্যানগুলির অন্য আর একটা দিক সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন – সেটা হল এই আখ্যানগুলি স্থির বা জড় নয়। তাদেরও একটা নিজস্ব জীবন আছে এবং মূল কিছু বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত রেখেও কিছু কিছু আখ্যান সময়ের সাথে বদলে যায়। তিনি দেখিয়েছেন বৈদিক দেবতা ও আখ্যানগুলি মহাভারত ও রামায়ণের উত্তরভাগে বদলাতে শুরু করে, যা আরো বেশী বদলে যায় পুরাণগুলিতে।  কিছু পুরোনো দেবতাদের ব্যক্তিত্ব বদলে যায় আর কিছু নতুন দেবতার দেখা পাওয়া যায়। পুরাতন বৈদিক দেবতারা স্পষ্টত গৌণ হয়ে পড়েন বা আস্তে আস্তে পশ্চাদপটে চলে যান। বৈদিক মিত্র-বরুণ, অগ্নি ও ইন্দ্র রাস্তা ছেড়ে দেন দুই প্রভাবশালী দেবতা, বিষ্ণু ও শিবকে।
নব্য দেবতারা দুটো মূল নীতি চিত্রিত করেন। ব্রহ্মা সৃষ্টি করার পর বিষ্ণু সেই সৃষ্টি পালন করেন, শিবকে যুক্ত করা হয় সৃষ্টিকে ধ্বংসের সাথে। সুকুমারী ভট্টাচার্য বলছেন যে এই দ্বিত্ব (duality) পরস্পরবিরোধী হলেও কিন্তু এটা বৈষ্ণব ও শৈবদের আচার-বিশ্বাসের একটা দিক। বৈদিক যজ্ঞ, যা ছিল বৈদিক উপাসনার প্রধান অঙ্গ, মন্দিরে মূর্তিপূজার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হল। পূজা করতে মাত্র একজন বা দুজন পুরোহিতের প্রয়োজন হয়, বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের মতো ষোল জনের নয়। প্রার্থনা ও মন্ত্রগুলিও আলাদা। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও বদলে যায় এবং শূদ্র ও নারী, যারা আগে যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ বহিষ্কৃত ছিল, তাদের অল্পস্বল্প জায়গা করে দেওয়া হয় - যদিও পুরোপুরিভাবে নয়, কারণ আমরা জানি যে অনেক মন্দির ও জনগোষ্ঠীরা সম্পূর্ণ  বাইরে রাখত নিচু জাতের মানুষ ও নারীদের, যাদের নিজেদের উপস্থিতি বহাল রাখতে অনেক কষ্ট করতে হত। কিন্তু নতুন প্রকারের ধর্ম নারীদের অনেক বেশী গুরুত্ব দেয় এবং দুর্গা ও লক্ষ্মী এই দেবতাগনের কেন্দ্রের দুই দেবী।
এই ছিল নতুন ধারনার এক হিন্দুধর্মের শুরু। সুকুমারী ভট্টাচার্য একেই আমাদের জানা-চেনা ও আচরিত হিন্দু ধর্ম বলেছেন আর অন্য লেখকরা একে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম (Puranic Hinduism) বলেছেন, বৈদিক হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা করে দেখানোর জন্য। এতে ‘ভক্তি’র ধারনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, অহিংসার দিকে কিছুটা জোর, আর তার সাথে ‘কর্ম’ ও ‘সংসার’-এর মতবাদ - এই সমস্তই এই ধর্মের বিশ্বাস এবং উপাসনার বৈশিষ্ট্য।
আমাদের কাছে প্রশ্ন অনেক। সুকুমারী ভট্টাচার্য কিছু প্রশ্ন তুলেছেন ও তার সাথে অন্যদের উৎসাহ দিয়েছেন নিহিত অনুল্লেখিত প্রশ্নগুলি তোলবার জন্য। পৌরাণিক হিন্দুধর্ম কি অ-বৈদিক দেবদেবীদের উপাসনার পুনরুত্থান, যারা এতদিন গুরুত্ব না পেয়ে অলক্ষ্যে ছিল? অহিংসার ওপর নতুন করে জোর দেওয়া থেকে কি ধারনা হয় যে  এতে কি বৌদ্ধ ও জৈন  শ্রমণদের প্রভাব আছে? এর সাথে সাথে কি স্থানীয় লৌকিক ধর্মের পুনরুত্থান হয়েছিল? - যাতে পবিত্র জায়গা, গাছপালা, বিভিন্ন অশরীরীদের পূজা এবং বিশেষ করে দেবমাতৃকার পূজা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা মনে করিয়ে দেয় হরপ্পার ধর্মের কথা, যার সম্বন্ধে আমরা খুব কমই জানি।
The Indian Theogony  বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে পুরাণের যুগ অবধি বিভিন্ন দেব-দেবী ও পৌরাণিক আখ্যানের এক তথ্যপূর্ণ বই। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা এই বইটি পণ্ডিতদের যা করা উচিৎ, তাই করে – অর্থাৎ প্রশ্ন করতে উৎসাহ যোগায়। এই প্রশ্নগুলির জবাব খুঁজতে খুঁজতেই এই ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান সম্মুখবর্তী হয়।
(এই লেখাটি লেখিকা exclusively অবসর-এর জন্য লিখেছেন। মূল ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদ – 'অবসর' -এর সম্পাদক। )
সৌজন্যে: অবসর ডট নেট

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...