সত্তর দশকের শুরুতে দুই সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেল (Danial Bell) এবং আলা তুরে (Alain Tauraine) এই যুক্তি দেখিয়েছেন যে, মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। যাকে উত্তর শিল্প সমাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়। উত্তর শিল্প সমাজের ভিত্তি হচ্ছে তথ্য ও জ্ঞান। এই সমাজে প্রস্তুত শিল্পের অবক্ষয় ঘটে। মূলধনের মালিক বা শিল্পপতিদের স্থান অধিকার করে নেয় পেশাভিত্তিক ব্যবস্থাপক। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষার বিস্তার ঘটে। এভাবেই ক্রমশ উত্তর শিল্পযুগের ধারণা থেকে তৈরী হয়েছে উত্তরাধিকতার ধারণা। অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন- আমরা নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছি, যাকে উত্তর আধুনিক যুগ বলা যায়।
উত্তর আধুনিকতার ধারণাটি মূলত : পণ্যের উৎপাদন বিপণন এবং এর উৎকর্ষতা সম্পর্কিত ধারণা হলেও সাহিত্যে এই ধারণাটি বহু পুরানো। পবিত্র সরকার তার একটি প্রবন্ধে বলেছেন- পোস্ট মডার্ন নিজম’ নামটির বয়স আজ একশ ত্রিশ বছরের মতো হলো। উত্তর আধুনিক স্থাপত্য ও শিল্প বিশেষজ্ঞ চার্লস জেং কস খবরের কাগজে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, ১৮৭০ সালের লেখা কোন গ্রন্থে এই শব্দটির তিনি লক্ষ্য করেছেন। তার ধারণা শব্দটির প্রয়োগ বোধহয় তখন যেভাবে এবং যে অর্থে উল্লেখিত হতো পরবর্তীকালে এর অর্থ প্রয়োগ ভিন্ন হয়ে যায়।
আধুনিকতার যেখানে শেষ উত্তর আধুনিকতা সেখান থেকে শুরু যদি এ রকম একটা ভাবনা আমাদের মনে আসে তাহলে এটা যুক্তি হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে। কিন্তু উত্তর আধুনিকতার সংজ্ঞা হিসেবে গ্রাহ্য হবে না। পোস্ট-মডার্ন শব্দটি বিভিন্ন দশকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়েছে- কখনো এটা বন্ধনমুক্ত মানুষ, কখনো শিল্প বিপ্লব, কখনো প্রযুক্তির আধিপত্যে সার্বিক সমতা জীবন যাপন আবার কখনো আধুনিকতার মাঝে থেকে চৈতন্যগত কারণে পৃথক একটি ধারা হিসেবে এর ব্যবহার হয়েছে। তবে এটা কোনো গোষ্ঠী বা আন্দোলনের বিধিসম্মত কাঠামোর রূপ নেয়নি। কোন দার্শনিক মতবাদও দাঁড় করাতে পারেনি। উত্তর আধুনিকতা কোনো বিষয়ের বা ভাবের গভীরে প্রবেশের তোয়াক্কা করে না। এটা অস্তিত্বহীন, ফাঁপা খোলসের মতো এই খোলস আবার দৃষ্টিনন্দন নয়, মনে রাখার মতো বা রেখাপাত করার মতো ব্যাপারও নয়। উত্তর আধূনিক লেখক বা কবি কে বলতে চান তা নিজেই জানেন না, চলমান বা বর্তমান সব কিছুই তার কাছে অগ্রাহ্য, ঐতিহ্য, ইতিহতাস, সামাজিকতার বিরুদ্ধে সময়কেন্দ্রিক বিদ্রোহের একটি শক্তিশালী অথবা দুর্বল বিদ্রোহের নামই উত্তর আধুনিকতা। উত্তর আধুনিকতার উদ্ভব সাহিত্য ও দর্শনে খুব জোরালোভাবে না হলেও ক্ষীণভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এর নমুনা বা উদাহরণ হাজির করতে গিয়ে- প্রচলিত ধারায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবু আলো-আঁধারী এবং মরীচিকার মতো উত্তর আধুনিকতার অবয়ব নিয়ে কিছু ব্যর্থ বা অসংলগ্ন কথা বলার চেষ্টা করবো।
উত্তর আধুনিকতা বা পোস্ট মডার্ন ইজমের ধারণাটি কখনো স্থির নয়, কোনো যুক্তির ঐক্যতে স্বীকার করাও পোস্টমডার্ন ইজমের কাজ নয়। একই ঐক্যের দিকে সহ¯্র ধারায় সম্মিলন পোস্ট মর্ডার্ননিজমে ব্যক্তির ইচ্ছা, স্বাধীনতা, ঐতিহ্য, বিচার ক্ষমতা, সার্বজনীনতা, আন্তর্জাতিকতা এবং মূল্যবোধ একই অবস্থান থেকে অক্ষুন্ন থাকে। পোস্টমডার্ন ইজম কোনো সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে না। পোস্টমডার্ন ইজম প্রতিটি ভাবনার মধ্যে বৈচিত্র্যের মালা পড়িয়ে দেয়া আর প্রতিটি চিন্তার মধ্যে এনে দেয়া অভিনবত্বের ছোঁয়া। এর প্রতিটি দর্শন অসীমের প্রান্তপর্যন্ত প্রসারিত। এটি সময় বিভাজনে বিশ্বাসী নয় আবার সময়ের স্তর পেরিয়ে ও এর যাত্র শুরু হয় না। ধারণাটি প্রয়োগিক এবং বৈচিত্র্য সন্ধানী।
পোস্টমডার্ন ইজমের সংজ্ঞা দেয়া বা ষূত্র সন্ধান ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। এর মধ্যেও কোনো কোনো লেখক পোস্টমডার্ন ইজমের প্রবণতা খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। কবিতার মধ্যে এর লক্ষণগুলো কিভাবে আমরা লক্ষ্য করবো তার একটি ধারণা পাওয়া যায় পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতাগ্রন্থে, তিনি তার গ্রন্থে পোস্টমডার্ন কবিতা চিনার বেশকিছু সূত্রের ন্যায় তালিকা পেশ করেছেন। তার এই দীর্ঘ তালিকা থেকে দশটি বচন এখানে উল্লেখ করবো।
১. বিষয়কেন্দ্রিকতার অভাব। পোস্টমডার্ন কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় কেন্দ্র, ভাবনা কেন্দ্র থাকবে না।
২. পোস্টমর্ডান কবিতায় যুক্তি কাঠামো অনুক্রম অনুপস্থিত থাকবে। কবিতাটি close ended হয় না Open ended হয়, কবিতাটি শেষ হলেও মনে হবেÑ তা শেষ হয়নি।
৩. পোস্টমর্ডান কবিতা বহুরৈখিক, বহুকৌণিক, বহুত্ববাদী ও বিদিশাময়। এর যে কোনো দিকে ছড়িয়ে পড়ার অভিমুখ খোলা থাকে।
৪. পোস্টমর্ডাননিজম কোনো পূর্ব নির্ধারিত সূত্র নয়, জীবনকে দেখেশুনে মনে মনে তার লক্ষণগুলো যোগসূত্র ঠাউরে নিয়ে পোস্টমর্ডান পোস্টমর্ডাননিজমের যাত্রা শুরু। পোস্টমর্ডাননিজম কোনো আন্দোলন নয়, একটা কালখ-ের প্রবণতা মাত্র।
৫. পোস্টমর্ডান কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো যুক্তিতে ফাটল ধরানো লজিক্যাল ক্রাক ক্লেফটের উপস্থিতিতেই এর লক্ষণ হিসেবে বিবেচ্য।
৬. পোস্টমর্ডাননিজম কবিতা কোনো আদর্শ খাড়া করতে চায় না, এর গতি যে কোনো যাত্রার দিকে ইঙ্গিত দেয়।
৭. পোস্ট মর্ডাননিজম কবিতায় কবির ইমেজ তৈরি সম্ভব নয়।
৮. পোস্টমর্ডাননিজম কবিতা যে কোনো সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, ফলে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় একে আবদ্ধ করা যায় না।
৯. আধুনিক কবিতা ছিলো সা¤্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনা সমৃদ্ধ এবং এই চেতনা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
পোস্টমর্ডান কবিতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার উপস্থিতি নেই।
১০. জীবনের যে কোনো এলাকা থেকে পোস্টমর্ডান কবি তার কবিতার মাল মশলা বা উপাদান সংগ্রহ করতে পারেন। এটা কবিতায় চলছে না, ওটা কবিতায় খাটে না, এই ধরনের বাছ বিচার পোস্টমর্ডান কবিরা অগ্রাহ্য করেন।
পোস্টমর্ডান বা উত্তর আধুনিকতা কি? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। পোস্টমর্ডান ইজম এর ধারণা তত্ত্ব ও মননের সিড়ি ভেঙ্গে চূড়ায় উঠার বা লাফিয়ে পড়ার বাস না। আমরা যদি এরপরও কোনো প্রশ্ন করতে চাই তাহলে উত্তর আধুনিক কোনো গবেষক হয়তো চুপ করে থাকবেন। এই চুপ থাকাই তার উত্তর। প্রশ্নকারী-উত্তরদাতার উত্তর-বুঝানো কি বুঝলো না উত্তর আধুনিকতাবাদীর সে বিষয়ে মাথা ঘামানো নিষ্প্রয়োজন। এটা হেঁয়ালির মতো শোনায়। যেন ধাঁধাঁ লাগানো কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেনÑ প্রশ্নকারী দিনের পর দিন এর সমাধান খুঁজেন। উত্তর আধুনিকতা যেন উপনিষদের সেই জিজ্ঞাসুকে ভয় দেখানোর মতো ঋষি জিজ্ঞাসকে এই বলে ভয় দেখিয়েছিলেনÑ আর প্রশ্ন করো না, তাহলে তোমার মু-ু খসে পড়বে। উত্তর আধুনিকতা এমন ভয় না দেখালেও উত্তর আধুনিকতা বুঝার জন্য নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করার এবং বুঝার পরিশ্রম করার আগ্রহ সৃষ্টি করে। উত্তর-আধুনিকতা হচ্ছে সামুরাইদের ক্ষিপ্র তরোয়াল চালানোর মতো, উত্তর আধুনিকতায় ভাবনার সীমাহীন প্রান্তে নিয়ে যায়। উত্তর আধুনিকতা শূন্যের মধ্যে শিকড়ের সন্ধান করেন। এ শিকড় কোথায় গেছে তা তিনি জানেন নাÑ কিন্তু তিনি যে বিষয়হীন বিষয়ে ভাবার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এটাই তার নতুন অর্জন। এই ভাবনার মধ্যে তার পুরানো অভিজ্ঞতার কোনো ভারক্রান্ত সঞ্চয় থাকে না। উত্তর আধুনিকতা উত্তাল ঝড়ের মাঝে একটি স্তব্ধ কেন্দ্র খুঁজে পেতে চায়, ধুমাঙ্কিত শিখার মাঝখানে যে ¯িœগ্ধতার বিন্দুটি আছে কিন্তু দহনের অস্তিত্ব নেই, সেই বিন্দুটির সন্ধান করে।
উত্তর আধুনিক কবিরা চোখের মণিকেন্দ্রের একটি স্থান আছে যা কিছুই দেখতে পায় নাÑ কিন্তু তাদের কাছে সেই অন্ধকার আলোর অধিক। শূন্যতার মধ্য থেকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়াই উত্তর আধুনিক অভিপ্রায়। তাই উত্তর আধুনিক কোনো কবি যখন কবিতা নেবেন বা শিল্পী ছবি আঁকেন তখন তিনি বিপ্রতীপ কোন নির্মাণ করেন না, তার সৃষ্টি নিসর্গের সন্নিহিত কোণের নির্মাণ। শিল্পী যখন ছবি আঁকেন, তখন দর্শকদের হাত ধরে তিনি তার ভিতর হারিয়ে যান। উত্তর আধুনিকদের কাছে শূন্য শুধু শূন্য নয়, তা দীপ্ত ব্যথাময় অস্তিত্ব, তা কাঠামোয় অনুপেয়।
উত্তর আধুনিকতায় অতীত নেই, ভবিষ্যত নেই। শুধু আছে বর্তমান এটাই উত্তরাধুনিকতার মূল ধারণা। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা এই মহার্ঘ শূন্যতার কথাই বলতে চেয়েছেন। তবে উত্তরাধুনিকতা কখনো বর্তমান বা বাস্তবের অবিকল অনুকৃতি নয়, যা দেখে তাও বলে না এর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তিও বিস্তার আছে, সেই সাথে আছে স্পষ্ট লঘুতা।
তবে এটাও মনে রাখা দরকার আমাদের দেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর আধুনিকতার চর্চা এবং আলোচনা ইউরোপের আদলে নয়। ইউরোপের উত্তর আধুনিকতা সম্পূর্ণ ঐতিহ্যের সংগে বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে স্পষ্ট নেয় যে কয়জন কবি কবিতার শৈলী ও রূপ নিয়ে উত্তর আধুনিক ধারায় অগ্রসর হতে চেয়েছেন তারা কিন্তু কোনোভাবেই ঐতিহ্যকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। আমাদের দেশে সাহিত্যও শিল্প কথায় পশ্চিমাদের অনুসরণ একটি ফ্যাশান। যার কারণে তাদের প্রচলিত আন্দোলনের ইতিহাসে আমরা পড়তে বাধ্য হই। মূলত সাহিত্য বিচারে ক্লাসিক, নিউ ক্লাসিক, রোমান্টিক আধুনিক, উত্তর আধুনিক কাজ বিচারে বা সাহিত্য বিচারে মোড়ক বিশেষ। এই নামের মোড়কে বিচার করলেই কি সাহিত্যের উৎকর্ষতা বেড়ে যায়? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজাও প্রয়োজন।(মাখরাজ খান)
সুত্র: দৈনিক সংগ্রাম
*** লেখাটির সমস্ত কৃতিত্ব "দৈনিক সংগ্রাম" ওয়েবনিউজের।
*** লেখাটির সমস্ত কৃতিত্ব "দৈনিক সংগ্রাম" ওয়েবনিউজের।
Comments
Post a Comment