Skip to main content

আমাদের পদবীর পেছনের ইতিহাস



আমাদের প্রত্যেকের নামের শেষে আমরা একটি পদবী যুক্ত করি | যেমন কারও নাম ধরুন অমিত সরকার, এখানে অমিত টা তার নাম এবং শেষের অংশ টুকু তার পদবী | আজ এই পদবীর উদ্ভব হল কীভাবে সেই সম্পর্কে আলোচনা করব |

বাঙালীদের বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশী প্রাচীন নয় | মধ্য যুগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয় | সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবী | আবার অষ্টম শতকে বাংলাদেশ চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন, যার নাম ছিল গোপাল | কিন্তু গোপালের নামের শেষ অংশ ( গো - পাল ) ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় তাঁর উত্তরাধিকাররা ক্রমান্নয়ে সকলেই নামের শেষে গোপালের 'পাল ' অংশকে পদবী হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন | বল্লাল সেনের আমলেও ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল | সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবীরও সৃষ্টি হয় পেশাগত গুনে |

যাইহোক এখন বিভিন্ন পদবীর উদ্ভব কীভাবে হয় সংক্ষিপ্তভাবে তা বলছি ---------

শিকদার ::-- আরবি শিক হল একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ | এর সঙ্গে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে | এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী | শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী | এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করত বলে শিকদার উপাধি পেয়েছিল, সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে |

দাস ::--

যে সব হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পদবীতে দাশ লিখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে পদবী এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন | আর যারা দাস লেখেন তাদের পদবী স্রষ্টার ভূত্য চেতনা থেকে এসেছে |

চৌধুরী ::--

সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ | এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তর্গত শাসক | বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী ছিল চৌধুরী | আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী যার অর্থ এক চতুর্থাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চরণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে চৌধুরী | সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় | বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে চতুর যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ , তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর ( ধারক) এবং এই দুই এ মিলে হয়েছে চৌধরী > আর তার থেকেই চৌধুরী |

মজুমদার ::--

ফারসি শব্দ মজমু আনদার. থেকে এসেছে মজুমদার | রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল |

তরফদার ::--

আরবি শব্দ তরফ এবং ফারসি শব্দ দার মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি | রাজ্যের খাজনা আদায়কারীর উপাধি ছিল তরফদার | এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা রাজকার্য পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন | সেখান থেকেই এই বংশ পদবীর উৎপত্তি হয়েছে |

সরকার ::---

সরকার শব্দটি ফারসি থেকে আগত | এর অর্থ প্রভু, মালিক , ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা | মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারীদের এই পদবী দেওয়া হত | এদের কাজ ছিল রাজকীয় সম্পত্তি দেখাশোনা করা |

মন্ডল ::---- হিন্দু ও মুসলিম সমাজে সমানভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী | বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে গ্রাম প্রধান কে বলা হত মন্ডল |খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীণ বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন |

ঠাকুর ::--

বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের মতে। ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে ( সংস্কৃত ) ঠাক্কুর তা থেকে >( প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে | পদবীগত দিক থেকে এটি ব্রাহ্মণদের পদবী বিশেষ |মধ্যযুগের কাব্য চৈতন্য ভাগবত উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন এটি বৈষ্ণবদেরও উপাধি |

বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের শেষাংশ থেকে যে সব পদবীর উৎপত্তি ::-----

যে নামগুলো দুটো অক্ষরের চেয়ে বেশী হত, সেগুলো উচ্চারণ করার সময় দুটো শব্দ হিসাবে উচ্চারিত হত | অনেক সময় মনে হত, দুটো পৃথক শব্দ | সেরকম নামের কেউ বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা নিজেদের কে ওই বিখ্যাত লোকের উত্তরাধিকারী বোঝার জন্য নিজের নামের সঙ্গে সেই বিখ্যাত লোকের নামের শেষাংশ জুড়ে দিতেন | সেই রুপ পদবী গুলি হল :::::------

বিখ্যাত ব্যক্তির নাম এবং পদবী :::----

বাণভট্ট, গোপালভট্ট বা আর্যভট্ট. থেকে ভট্ট পদবী |
অশ্বঘোষ, ঈশ্বরঘোষ বা অনন্ত ঘোষ থেকে ঘোষ পদবী | এখানে বলে রাখা দরকার এই ঘোষ, ভট্ট এগুলি কিন্তু নামেরই অংশ ছিল পরবর্তীকালে এদের পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ব পুরুষ দের নামের শেষাংশ নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিল |

বিশ্ব বসু বা পৃথ্বীবসু থেকে বসু পদবীর উৎপত্তি |

মহাবল, ইন্দ্রবল থেকে বল পদবী |

বিষ্ণুশর্মার নাম থেকে শর্মা পদবী |

পরহিতভদ্র থেকে ভদ্র পদবী |

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার একটি নামের তিনটি অংশই পরবর্তী কালে আলাদা আলাদা পদবী হয়েছিল | যেমন ::-- আদিত্যসেনগুপ্ত | এটা একটাই নাম | পরে আদিত্য, সেন এবং গুপ্ত নামে পৃথক পৃথক পদবী তৈরি হয়েছে | বিক্রমাদিত্য, ললিতাদিত্য জাতীয় নামের শেষাংশ থেকেও অবশ্য আদিত্য এসে থাকতে পারে |

ভট্টাচার্য ::---

আগে বাণভট্ট, গোপালভট্ট, আনন্দভট্টদের কথা বলেছিলাম | এদের বংশধরেরা নিজের নামের সঙ্গে ভট্ট ব্যবহার করতেন ঠিকই, এই ভট্টদেরই কোনও একজন আচার্য হয়ে ওঠার পরে তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা ভট্টর সঙ্গে আচার্য যোগ করে ' ভট্টাচার্য ' পদবির প্রচলন করেন |

চ্যাটার্জী ::--

চাটু বা চাটুতি থেকে চট্ট | কেউ কেউ বলেন চাটু গ্রামের সঙ্গে হিন্দি জী বা জীউ জুড়ে ধীরে ধীরে চাটুর জীয়া, চাটুর্জ্যা, চাটুর্জ্যে, চাটুজ্যে হয়েছে | 1760 সালের পরে ইংরেজী রুপ পায় চ্যাটার্জী |

বন্দোপাধ্যায় ::---

বন্ডউরী, বাঁড়ুরি রাঁড়বি গাঁইগুঁই থেকে হয়েছে বাঁড়ুজ্যে | শান্ডিল্য গোত্রের বাঁড়ুরি গাঁইদের আর একটি নিবাস বন্দি ঘটি | সেখান থেকে বন্দ | অন্য মতে, বাড়ব বাড়বি গ্রাম থেকে বাড়বি ও বন্দো, মুখ্যো গ্রাম থেকে মুখটি বা মুকুটি বা মুখড়া গ্রাম থেকে মুখুজ্যে | তেমনই গঙ্গা কুলির থেকে গঙ্গৌলি, গাঙ্গুলি | প্রায় 260 বছর আগে ইংরেজ আমলে এই পদাধিকারদের মনে হল তাঁরা একসময় ওঝা ছিলেন | ওঝা মানে উপাধ্যায় | উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা পড়াতেন তাঁদের উপাধ্যায় বলা হত | সেটা ছিল খুব সন্মান জনক পদ |ফলে তারা যে সন্মানিত ব্যক্তির বংশধর সেটা বোঝার জন্যই তাঁরা তাঁদের পদবির সঙ্গে উপাধ্যায় যোগ করে চট্টোপাধ্যায়, বন্দোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন | গঙ্গ বা গাঙুর হলেন গঙ্গোপাধ্যায় |

আরও প্রচুর পদবীর অস্তিত্ব রয়েছে | এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে লেখক লোকেশ্বর বসুর ' আমাদের পদবীর ইতিহাস ' বইটি পড়ে নিতে পারেন |
(পাপাই)

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...