কোপার্নিকাস আকাশ দেখছেন , ছবির সৌজন্যে: উইকিপিডিয়া
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ থেকেই ইউরোপের বিজ্ঞানের জগতে নতুন চেতনার উদ্ভব করতে থাকে । এক্ষেত্রে গ্রিক এবং আরবীয় বিজ্ঞান চর্চা ইউরোপের এই বিজ্ঞানের জগতের উন্নতির ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল । ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের দুটি দিক রয়েছে । একদিকে এটি যেমন বিজ্ঞানের ব্যবহারিক জগতে এক বিপুল পরিবর্তন এসেছিল ঠিক অন্যদিকেই বিজ্ঞান দর্শনের ক্ষেত্রে পূর্বের চিন্তাধারার মধ্যেও এক বিপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল ।
সমগ্র ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে ইউরোপের এই বিজ্ঞান বিপ্লব চলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এর শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে যা পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল । অর্থাৎ আমরা বলতে পারি ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবেরও একটা বড় অবদান রয়েছে। মহাবিশ্ব ও মানব শরীর এই সময় বিজ্ঞান গবেষণার মূল কেন্দ্রে চলে আসে । আলোচনা হতে থাকে জড় পদার্থের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কের বিষয়টি, অর্থাৎ প্রকৃতি বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ বৃদ্ধি ঘটে । আবার এর সাথে চলতে থাকে প্রাকৃতিক এবং স্বর্গীয় বিষয়াদির মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা । বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের হাত ধরে আসা প্রযুক্তির উন্নতি আবার ভৌগোলিক আবিষ্কারেও সহায়ক হয় । অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদির অগ্রগতি ধীরে ধীরে ইউরোপের বিজ্ঞান জগতকে সমৃদ্ধ করে তোলে । Robert Grossetest, John Buridan, Nicholas Oreseme - প্রমুখো বিজ্ঞানীরা পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষেই এটা সুনিশ্চিত করেছিলেন যে ইউরোপের অংক ও পদার্থবিদ্যার জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসন্ন নিশ্চিত । তাদের কথা সত্যতা পরবর্তী শতাব্দীর বিজ্ঞানের অগ্রগতির মধ্যেই ধরা পড়ে ।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক পটভূমিকার মাধ্যমে যাঁরা দেখতে চান তাঁদের মতে পুঁজিবাদী কাঠামো উদ্ভবের সাথে বিজ্ঞান বিপ্লব জড়িত ছিল ; জড়িত ছিল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের উত্থানের সঙ্গে । কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন , পুঁজিবাদের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সামাজিক এবং সংস্কৃতিগত বিপুল পরিবর্তন আসে । বিজ্ঞান বিপ্লবের প্রস্তুতি চলছিল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে । পুনরালোচিত হচ্ছিল এমন কতগুলি বিষয় যা পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের চিরকালের সম্পদ । পিথাগোরাসের অঙ্কশাস্ত্র , ইউক্লিডের জ্যামিতি , প্লেটোর দার্শনিক বিচার (Platonic Speculation ) , আর্কিমিডিসের সূত্রাবলী , টলেমির ( Prolemy ) জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ , গ্যালেনের চিকিৎসাশাস্ত্র , হুগাইল ইবন ইসাকের ( ৭৯২-৮৭৩ খৃঃ ) চিকিৎসাশাস্ত্র , ইবনোসিলার শারীরবিদ্যা এবং অন্যান্য আরবীয় পণ্ডিতদের চর্চা করা রসায়নশাস্ত্র , জ্যোতির্বিদ্যা , চিকিৎসাবিজ্ঞান , প্রভৃতি পুনরায় আলোচিত হতে শুরু করেছিল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ।
পরবর্তীকালে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিল ঠিকই এবং চারশো বছর পরে ষোড়শ শতাব্দী থেকে বিজ্ঞান বিপ্লবের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল । তবু একথা বলা যায় যে প্রাচীন বিষয়গুলির চর্চা ইউরোপে ক্রমশঃ বিজ্ঞান বিপ্লবের জমি প্রস্তুত করেছিল । নবজাগরণ বা রেনেসাঁস ( পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী ) আর যুদ্ধ ( ১৫৪০-১৬৫০ ) এবং ধর্মসংস্কার ( ১৬৫০-৯০ ) এর ভেতর দিয়ে বিজ্ঞান বিপ্লব এসেছিল । ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন হয়েছিল অনেকটা । নগররাষ্ট্র বিশেষ করে ইতালিয়ান নগররাষ্ট্রের মডেল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল । বাণিজ্য নগরীর উত্থান হয়েছিল দ্রুত গতিতে এবং নৌশক্তিতে বলীয়ান ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি দ্রুত আরো নতুন দেশ আবিষ্কার আরম্ভ করেছিল । মানচিত্র , চার্ট , কম্পাস ইত্যাদি সামুদ্রিক চলাচলজনিত আবিষ্কার ও সামুদ্রিক বিজ্ঞানের দপয়েলা তৈরি হয়েছিল । পর্তুগাল , স্পেন ইংলণ্ড , হল্যান্ড , ফ্রান্সে নৌবিজ্ঞান নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছিল । চালিত হয়েছিল বহু নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব , এবং বিজ্ঞানের দর্শন তৈরি হয়েছিল । এব্যাপারে রেনে দেকার্তের ( Rene Descartes 1596-1650 ) নাম উল্লেখযোগ্য । বিজ্ঞান বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যে দর্শন প্রয়োজন হয়েছিল তার উল্লেখযোগ্য ।
রেনে দেকার্ত তার দ্বৈতবাদ তত্ত্বের মাধ্যমে বস্তু জগৎ ও আধ্যাত্মিক জগৎকে পৃথকভাবে তুলে ধরেন । তিনি তার নতুন চিন্তাধারার সূত্রপাত করেছিলেন জ্যামিতিক সূত্রের হাত ধরে। তিনি ঈশ্বরকে আলাদা রেখে বস্তু জগতের ভিন্ন ব্যাখ্যা করতে শিখিয়েছিলেন । এরফলে বিজ্ঞান বিপ্লবের শিরদাঁড়া অনেকটাই শক্ত হয়েছিল । ইউরোপ ভাবতে শিখেছিল বস্তুগত সত্য আর নীতিগত সত্য আলাদা । আবার ফ্রান্সিস বেকোন তাঁর নোভাম অর্গানাম (Novum Organum) পুস্তিকার মাধ্যমে গবেষণালব্ধ প্রমাণের উপর জোর দিয়েছিলেন ।
সুতরাং এ কথা আমরা বলতে পারি, ইউরোপের বিজ্ঞান বিপ্লবের পেছনে পূর্ববর্তী শতকের বৈজ্ঞানিকদের চিন্তাধারা এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতির নিরলস প্রচেষ্টার এক বড় ভূমিকা রয়েছে । এর ফলে বৈজ্ঞানিক জগত এক নতুন চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে যেখানে বলা হয় তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণালব্ধ প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র যুক্তির ভিত্তিতে বিজ্ঞান অচল । এর ফলে সমাজে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কুসংস্কার ও ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে খুব সহজেই জেহাদ তোলা সম্ভব হয়েছিল । যার ফলে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এক নতুন পরিচয় পেয়েছিল ।
Comments
Post a Comment