রেনেসাঁ যুগে শুধুমাত্র সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ক্ষেত্রেই বিপ্লব আসেনি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন তথা বিপ্লবিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে । উদ্ভিদবিদ্যা , প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি সবকিছুতেই নতুনত্বের গন্ধ ছড়ায়। মহাকাশ বিদ্যা তথা জ্যোতির্বিদ্যার নবযুগ শুরু হয় । Hale বলেছেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে রেনেসাঁস পর্বের বিজ্ঞানে অনুসন্ধিৎসার এক নব যুগ শুরু হয় । কোপার্নিকাসের ব্যাখ্যা ও তার উত্থান আমরা এই সময়ই দেখি । রেনেসাঁ পর্বে ভূগোলের উন্নতির মধ্য দিয়ে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করার এক উদ্দাম চেষ্টা শুরু হয়। বার্থালোমিউ দিয়াজ, কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা, ভেসপুচি, ফার্দিনান্দ ম্যাগলান প্রমুখের আবিষ্কার পৃথিবীর পুরনো মানচিত্রের পরিবর্তন করে নতুন মানচিত্রের সৃষ্টি করেছিল। সেই মানচিত্রের মধ্যে এমন এমন দেশের নাম যুক্ত হয় যেগুলি সম্পর্কে পূর্বে কোন ধারনাই ছিল না ।
ষোড়শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার জ্যোতির্বিদ্যাকে নতুন ব্যাখ্যা দেয় । এতদিন পর্যন্ত টলেমীয় তত্ত্ব শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত হচ্ছিল , এর একটা কারণ ছিল চার্চের ধারণার সঙ্গে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল টলেমীর ব্যবস্থা । ষোড়শ শতকে নিকোলাস কোপারনিকাস জ্যোতির্বিদ্যার নতুন প্রবর্তক রূপে আবির্ভূত হন এবং টলেমীর ধারণাকে অস্বীকার করেন । ১৫৪৩ সালে তাঁর বিখ্যাত বই “ On the revolution of celestial bodies ” প্রকাশিত হয় । নিকোলাস কোপার্নিকাস ( Nicolas Copernicus ) ঘোষণা করেন পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘুরছে । কোপার্নিকাসের এই কথায় খ্রীষ্টান ধর্মগুরুরা ক্রুদ্ধ হলেন কিন্তু রেনেসাঁসের বিজয়রথ এতে থামলো না । এর পর কেপলার ( Johannes Kepler 1571–1630 ) এসে কোপার্নিকাসের মত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন । গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ হিসাবে কেপলারের একটি বিখ্যাত আবিষ্কার ছিল । কেপলার মনে করতেন এই মহাবিশ্ব চলমান । শুধু পৃথিবী নয় অন্যান্য গ্রহও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে । কেপলার গ্রহের আবর্তনের তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন । কোপারনিকাস ছিলেন পোল্যাণ্ডের মানুষ কিন্তু তিনি বাস করতেন ইতালিতে । গ্যালিলিও ছিলেন ইতালির বিজ্ঞানী । কেপলার ছিলেন জার্মানীর আর টাইকো ব্রাহে ছিলেন ডেনমার্কের । চার্চের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এঁরা জ্যোতির্বিদ্যার কাজ চালান । জ্ঞানের জন্য অনুসন্ধিৎসা ছিল রেনেসাঁসের যুগলক্ষণ , তা ফুটে উঠেছিল এঁদের চিন্তায় । গ্যালিলিও গ্যালিলি ( Galileo Galilei 1564-1642 ) ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকের এবং সপ্তদশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক । গ্যালিলিওর বই The starry Messenger ( 1610 ) ছিল মহাকাশ চর্চার একটি অনবদ্য গ্রন্থ । গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেছিলেন । রেনেসাঁস যুগের বিজ্ঞানচর্চার গতিবেগ বাড়ে ষোড়শ শতাব্দীতে একথা ঠিকই , কিন্তু বিজ্ঞানচর্চা এর আগে শুরু হয়েছিল । একটু পেছনের দিকে গেলে এর উৎসচিহ্নগুলি খুঁজে পাওয়া যাবে । ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রজার বেকন হাতে কলমে বিজ্ঞান চর্চা করতেন । আতস কাঁচ আবিষ্কার করেন তিনি । এবং আলোকবিজ্ঞানের উপর একটা বই লেখেন এই বইটির নাম “ ওপাস মেজুস ” ।
এবার রেনেসাঁ পর্বের গণিতশাস্ত্রের উন্নতি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এই সময় বীজগণিত ত্রিকোণমিতির চর্চা পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। দেলকেচ্চো, বার্থালোমিউ প্রবুকের নাম উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিল । স্কটল্যান্ডের জন নেপিয়ার তাঁর "লাগারিথম" তত্ত্বের মাধ্যমে নতুনত্বের সন্ধান দেন । দশমিক পদ্ধতির ব্যবহার সম্পর্কেও নতুন ধারণার উদ্ভব হয় । অংকের বিভিন্ন চিহ্ন নিয়েও কিন্তু এই সময় নতুন গবেষণা দেখা যায় ।
লিওনার্ড ফিউলস, কন্যাদের ভন জেসনের দুজনই এই সময় উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন । প্রাণিবিদ্যার উপরেও নতুন নতুন বই লেখা হয় । এনাটমি চর্চার বিকাশ ঘটে । ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভেসিলাস 'ফেব্রিকা' নামে এনাটমির একটি বই প্রকাশ করেন । লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও চিত্রকলায় এর ব্যবহার করেন (এনাটমি)। শিল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানকে যুক্ত করা হয়, যার ফলে প্রযুক্তি বিদ্যা চর্চার বহু উন্নতি সাধিত হয়। একই সাথে রসায়নবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যারও উন্নতি ঘটে । টেলিস্কোপে দেখা দেওয়া মহাজাগতিক ছবি এঁকেছিলেন শিগোলি ।
১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হয় । ওদিকে ইতালিতে আবার ম্যাজিক লন্ডনের উদ্ভব হয় । উইলিয়াম গিলবার্ট বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সম্পর্কে নতুন তথ্য দেন। আবিষ্কার হয় সৌর ঘড়ি ও চুম্বক । সামুদ্রিক যন্ত্রের বিকাশ বিকাশ ঘটে, দিক নির্ণয়ের জন্য কম্পাস ব্যবহার করা হয় । গুটেনবার্গ আবার জার্মানিতে ছাপাখানা আবিষ্কার করেন । ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পুস্তক ছাপা হয় যা জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধিতে অনেকটাই সাহায্য করে । ছাপাখানায় বাইবেল কেউ অনুবাদ করা হয় । জার্মানিতে প্রথম ইস্পাত উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় । কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের ধারণা দেন হেলমোন্ট নামক একজন ব্যক্তি । রেনেসাঁ পর্বে বিজ্ঞানের এই ধরনের আবিষ্কার নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করে । যাকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব বললে ভুল হবে না ।
Comments
Post a Comment