Skip to main content

কাল মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ থেকে কতখানি ভিন্ন ছিল ?



 মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ ইউরোপিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ থেকে কতটা আলাদা? এ প্রশ্নের আলোচনার আগে দেখা দরকার সমাজতন্ত্রবাদ কি? সমাজতন্ত্রবাদ এমন এক মতবাদ, যা প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে। সমাজতন্ত্রবাদের দুটি ভাগ আছে যথা আদি বা ইউরোপিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ। প্রথম দিকে আদি সমাজতন্ত্রবাদ এর প্রাধান্য ছিল পরবর্তীকালে এই মতবাদের ত্রুটি লক্ষ্য করে মার্কস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রচার করেন। 

আদি সমাজতন্ত্রী প্রবক্তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার এবং রবার্ট কোয়েল ।  এদের দার্শনিক মতবাদ আধুনা নানাভাবে সমালোচিত হয়। এদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল এরা ছিলেন অবাস্তববাদী ও কল্পনাপ্রবণ ।  বাস্তব পরিস্থিতির সাথে তাদের পরিচয় ছিল না কিংবা বাস্তব আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তারা লঘুভাবে পরিবর্তনযোগ্য মনে করেছিলেন। তারা মনে করতেন শ্রেণী সংঘাত বা শ্রেণিবিদ্বেষ নয় শ্রেণী সহযোগিতার মধ্য দিয়েই সামাজিক সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে একদিন পুঁজিপতি শ্রেণীর মানবতাবাদ, সৎ চিন্তা ও ন্যায় বোধ উদ্ভব হবেই এবং তখন তারা মানুষের ওপর শোষণ চালিয়ে যেতে দ্বিধান্বিত হবেন । পুঁজিপতিদের সাথে বিভেদ নয় বরং সহযোগিতার মাধ্যমেই সমাজের কল্যাণ হবে এবং সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা হবে। এই ছিল আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের ধারণা মূলত আদি সমাজবাদীরা আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধানে কোন উপযুক্ত পথ নির্দেশ করতে পারেননি তাই পরবর্তীকালে মার্কস সহ অনেকেই সেই পথের সন্ধানে বেরিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠা করে করেছেন। 

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির এক ইহুদি পরিবারে মার্কসের জন্ম হয় ।দার্শনিক প্রভাবে তিনি দর্শন শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন । তবে বৈপ্লবিক মনোভাবের জন্য দেশ থেকে বহিষ্কৃত হন ও প্যারিসে চলে যান । এখানে এঙ্গেলসর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়, এরা দুজনে তাদের সৃষ্টির কাজ করে যান ।  কিন্তু প্রাশিয়া সরকারের চাপের ফলে ফরাসি সরকারও মার্কস কে বহিষ্কার করে । তারপর তিনি ব্রাসেলসে যান এবং সেখানে গঠন করেন কমিউনিস্ট লীগ । সেখান থেকেও বহিষ্কৃত হয়ে অবশেষে ইংল্যান্ডে যান এবং শেষ দিনগুলি সেখানেই কাটান ।

মার্কস তার 'কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টো' গ্রন্থ প্রকাশ করে তার সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা প্রথম প্রকাশ করেন এই গ্রন্থই তাকে বিশ্ব বিখ্যাত করে দেয়। এরপর তিনি রচনা করেন 'ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি' গ্রন্থটি। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকাশ করেন 'দাস ক্যাপিটাল', এই গ্রন্থে তিনি মার্কসবাদ এর তত্ত্ব গুলি বিশ্লেষণ করেন । ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে তার জীবনে অবসান হয় । 

আদি সমাজতন্ত্রীদের অসম্পূর্ণতা ও অবাস্তবতার আধিক্যের জন্য মার্কস এদের ইউটোপিয়ান  বা বাস্তবহীন, ভাববাদী বলে অভিহিত করেছেন। তাই এদের থেকে নিজের স্বতন্ত্র রক্ষার জন্য মার্কস "সাম্যবাদ বা কমিউনিজম" নামটি গ্রহণ করেছেন। মার্কস সমাজতন্ত্রকদের যুক্তিসম্মত ও ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করে তার প্রায়োগিক দিকের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন বলে তাকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ'র প্রবক্তা বলা হয়ে থাকে। তবে আদি সমাজতন্ত্রীদের সাথে নানা বিষয়ে মার্কসের পার্থক্য থাকলেও তারাই সমাজতন্ত্রবাদের পথপ্রদর্শক। 

মার্কস বিশ্বাস করতেন পরস্পর বিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থ ও শক্তি সংঘাতের ফলে ইতিহাসের বিবর্তন ঘটেছে । মার্কসের এই তত্ত্বকে "দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ" বলা হয় । ইতিহাসের ধারাকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে অত্যাচারীদের সংঘর্ষের কাহিনী বলে মনে করতেন। তিনি বলেন, সমাজ ও জীবনের প্রধান নিয়ন্ত্রক হলো অর্থনীতি। প্রাচীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে নতুন ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। মার্কসের মতে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য হলো, মালিক ও শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব। 

'দাস ক্যাপিটাল' গ্রন্থে বর্তমান সমাজকে বিশ্লেষণ করে মাপস দেখিয়েছেন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা একটি সাময়িক স্তর মাত্র। সংঘাতের ফলে যেমন পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের তলে অভিষিক্ত হয়েছে তেমনি একদিন পুঁজিবাদের ভাঙ্গন হবে এবং তার স্থল দখল করবে সমাজতন্ত্রবাদ। এই নতুন ব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষ তার ন্যায্য প্রয়োজন অনুযায়ী সামাজিক উৎপাদনের অংশ লাভ করবে, তার যোগ্যতা অনুযায়ী নয়। মার্কস বলেন পুঁজিবাদীদের ব্যক্তিগত মালিকানা সামাজিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে। 

মার্কস তার 'মূল্যতত্ত্ব'  ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, মূলধন ও মুনাফা কখনোই উৎপাদিত সামগ্রীর মূল্য নিরুপমের মাপকাঠি হতে পারে না। তার মতে সমস্ত সম্পদ সৃষ্টি হয় মানুষের শ্রমের দ্বারা। কোন সামগ্রীর প্রকৃত মূল্য হলো তার পশ্চাতে নিয়োজিত শ্রমের ফল মাত্র। তবে শ্রমিকরা বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে যা শ্রম দিচ্ছে তার প্রাপ্য মজুরি তারা পাচ্ছে না। প্রাপ্য মজুরির তুলনায় তাদের উৎপাদন অনেক বেশি। এইভাবেই সৃষ্টি হয় 'উদ্বৃত্ত মূল্য'। তাই তিনি চান, উৎপাদন সামগ্রির ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদনের বন্টন। 

মার্কস সমাজকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। পরস্পর বিরোধী এই দুটি শ্রেণি হল মালিক বা মূলধন শ্রেণী এবং শ্রমজীবী শ্রেণী। তার মতে, মূলধনী শ্রেণীর উচ্ছেদের মধ্যেই শ্রমজীবী শ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিহিত আছে। তার বিশ্বাস শোষনের জর্জরিত শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণ মুক্তির সংগ্রাম করবে,   পুঁজিপতি শ্রেণী বিলুপ্ত হবে এবং গড়ে উঠবে শ্রেণীহীন সমাজ। এজন্য তিনি সমস্ত বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধভাবে বৃত্তবান পুজিবতী শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হতে ডাক দেন, গঠন করেন "ফাস্ট ইন্টারন্যাশনাল"। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইন্টারন্যাশনালও স্থাপিত হয়েছিল, তবে তা তার মৃত্যুর পর। 

মাকর্স যেমন ইউটোপিয়ানদের মতবাদকে অবাস্তব ও ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন তেমনই তার মতবাদও ত্রুটিহীন ছিল না। প্রথমত, মার্কস বলেছেন সমস্ত উৎপাদনের মূলে শ্রমিকের শ্রম ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু এই মত ঠিক নয়, কারণ শিল্প পরিচালনা, নিয়োজিত মূলধন, বিজ্ঞাপন ব্যয় প্রভৃতি ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, মার্কস আবার বলেছেন বুর্জোয়া ব্যবস্থাতে শ্রমিকদের উন্নতি হয় না, কিন্তু গত অর্ধ শতাব্দীতে দেখা গেছে বুর্জোয়া ব্যবস্থাতেও শ্রমিকদের উন্নতি হয়েছে। তৃতীয়ত, মার্কসের মতবাদে ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ। মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সংঘাতের কাহিনী- এ তত্ত্ব সঠিক নয়। কারণ অন্যান্য কারণেও যেমন- দেশপ্রেম, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমেও ইতিহাসের গতির পরিবর্তন ঘটেছে। 

অবশ্য এইসব ত্রুটি সত্বেও মার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের গুরুত্ব অপরিসীম । এত সুনির্দিষ্টভাবে শোষণের চিত্র আদি সমাজতন্ত্রবাদীরাও তুলে ধরতে পারেননি । পুঁজিবাদের ত্রুটির প্রতি আঙ্গুল নির্দেশ করে এবং শোষণের সাথে সামাজিক বিবর্তনকে সংযুক্ত করে তিনি যে মতবাদ প্রচার করেছেন তা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দর্শনরূপে সর্বজনস্বীকৃত। পুঁজিবাদের বিপদজনক দিকগুলির ধ্বংসসাধন ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্কসের মতবাদ অবশ্যই অপ্রতিরোধ্য।

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...