Skip to main content

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপে কিভাবে ব্যাংকিং/ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ?

     আমস্টারডামের পুরনো টাউন হল , সৌজন্যে : উইকিপিডিয়া

ইউরোপে পনেরো শতকের বহু আগে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে ঋণ দেওয়া নেওয়া অঙ্গানিকভাবে জড়িয়ে ছিল । ব্যাংক গড়ে ওঠার মূল কারণই ছিল ব্যবসাদার সংস্থাগুলির সেবা ও সহযোগিতা । ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড নামে একটি সরকারি ব্যাংক পত্তনের আগে সরকারি ব্যাংকগুলি কেবল অর্থের আমানত আর সংস্থানের কাজ করতো। ঋণ বা আগাম দেওয়া অথবা শেয়ারের কাগজপত্রের কারবার করা- এসব করত না।  তাই এইসব কাজকর্ম ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ব্যাংকগুলি শুরু করতে থাকে।  ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে পরে ব্যাংকের কাজকর্ম করা আর ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্সের সংস্থাগুলির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে সুদূর ইংল্যান্ডের ওপরেও তারা নিজের আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিল । ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ব্যাংকিং পরিবারগুলি হল মেদিচি, বার্দি, পেরুজ্জি প্রভৃতি। এর মধ্যে মেদিচি নিঃসন্দেহে বিখ্যাত ছিল ।  ইউরোপীয় রাজারা নানা কারণে যথা প্রশাসন, সৈন্যবাহিনী, যুদ্ধ ইত্যাদির জন্য তারা এই সমস্ত ব্যাংকিং পরিবার গুলির কাছ থেকে ঋণী নিতেন ।  মূলত ফ্লোরেন্সি ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ও তৃতীয় এডওয়ার্ডের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে টাকা জুগিয়েছিল । 


 ষোড়শ শতকে ইউরোপের ব্যাংকিং কারবার ইতালি থেকে দক্ষিণ জার্মানিতে চলে যায় । ফুগার এবং ওয়েলসাররা ছিল বড় ব্যাংকিং পরিবার । এরা নানা ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিল । আবার বণিক ও রাজাদের ঋণ সরবরাহ করতো , আবার এরা ভৌগোলিক আবিষ্কারের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হতো তার সরবরাহও করত । বাণিজ্য সম্প্রসারণের ফলে ষোড়শ শতকে ভেনিসে কয়েকটি ব্যাংকিং পরিবার স্থাপিত হয়। এরা বণিকদের বাণিজ্য করবার জন্য ঋণ প্রদান করত । তবে বলাবাহুল্য ভেনিসের ঋণ সরবরাহের সংস্থাটি সেরকম উন্নত ছিল না । ভেনিসের ব্যাংকিং পরিবারগুলির মধ্যে টাইপোলো, পিসানি, প্রিউলি বিখ্যাত ছিল । তবে লেভান্ট বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলে এই ব্যাংকিং পরিবারগুলি দুরবস্থার মধ্যে পড়ে। এ যুগেই আবার ফ্লোরেন্স ফরাসি রাজতন্ত্রের সহায়তা নিয়ে লিঁওতে একটি ঋণ দানের কেন্দ্র গড়ে তোলে । মেদিচি পরিবার এখানে দুটি ব্যাংক স্থাপন করেছিল । উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মেদিচি পরিবার বাণিজ্যিক ঋণ সরবরাহ করার চেয়ে রাজাদের অগ্রিম দানের ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখাতো ।


মূলত পঞ্চদশ শুরুর শতকে ইউরোপের banking কারবারে চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটেছিল । ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নতুন ধরনের ঋণ সংস্থার প্রয়োজন হয়েছিল। স্বল্প মেয়াদী অর্থাৎ অল্প সময়ের জন্য বড় ধরনের ঋণের দরকার হয়েছিল মূলত যারা ভৌগোলিক আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বড় ধরনের ঋণ দেবে এমন ধরনের সংস্থার অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল  ।এই সময়ই আবির্ভাব ঘটে দক্ষিণ জার্মানির ঋণ ব্যবসায়ীদের ।


ষোড়শ শতকে ইউরোপে শিল্প ও বাণিজ্যের বড় ঘাটি হল আন্টওয়ার্প ।এখানে দক্ষিণ জার্মানি ওয়েলসার, ইমহোপ প্রভৃতি ব্যাংকিং পরিবার গড়ে ওঠে । এছাড়া মধ্য ইতালির কিছু ব্যাংকিং পরিবারও এখানকার ব্যাংকিং কারবারের সঙ্গে যুক্ত হয় । আন্টওয়ার্প  থেকে পূর্ব ও পশ্চিমে ইউরোপের বাণিজ্য চলত । দক্ষিণ জার্মানির পুঁজি এখানকার ঋণের বাজারেকে চাঙ্গা করেছিল আবার আন্টওয়ার্পের স্টকএক্সচেঞ্জ পর্তুগালের রাজার হয়ে কাজ করতো, ভৌগোলিক আবিষ্কারের জন্য এরা শেয়ার বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে দিত।  আন্টওয়ার্প ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নীতি চালু করে । স্পেনের রাজ পরিবারের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের জন্য ফুগার পরিবারের পতন ঘটেছিল । ইংল্যান্ড আন্টওয়ার্পের ওপর আর ভরসা করতে পারেনি। ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ ইংল্যান্ড নিজের স্টক এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছিল। । 

ষোলো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ছিল জেনোয়ার । আন্টওয়ার্পের পতনের পরে ইউরোপের ব্যাংকিং জগতে জেনোয়ার লোকেদের আধিপত্য স্থাপিত হয় । এবার সেখানকার সংস্থাগুলি সেই কাজ শুরু করেছিল যা সেকালে ছিল অভিনব তারা ঋণ দিতে শুরু করেছিল হুন্ডির বিনিময় । আর সেই হুন্ডি চলতে থাকে ইউরোপের এক মেলা থেকে অন্য মেলায়, এক বিনিময় কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে আবার স্পেনের ব্যাংকার হিসেবেও জেনোয়ার বণিকরা কাজ করতো।


ষোড়শ শতকের শেষ দিকে জেনোয় ইউরোপের পুঁজিব্যবসা থেকে সরে গেলে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে ডাচরা । ইউরোপে নতুন পুঁজি সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে আমস্টারডামে ব্যাংক স্থাপিত হয় ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে । রাষ্ট্র, ব্যাক্তি, রাজ্যসভা ও বণিকদের ঋণ সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল আমস্টারডাম। ইংল্যান্ড, জার্মানি ও হল্যান্ডের বাণিজ্যিক পুঁজির সরবরাহ করতো আমস্টারডাম। তবে বলা বাহুল্য রাজাদের ঋণ দিয়ে আমস্টারডাম ব্যাংক বিপদ ডেকে এনেছিল। অষ্টাদশ শতকে আমস্টারডাম ছাড়াও লন্ডন , প্যারিস, জেনিভাতে ব্যাংকিং ও বিনিময়ের কারবার জোরদার হয়ে উঠেছিল । আশির দশকের শেষ দিকে ফরাসি রাষ্ট্রের দেউলে অবস্থা প্রকট হয়ে, ওঠে সাথে সাথেই ফরাসি বিপ্লব শুরু হয় । ফলে ধ্বংস হয়ে যায় আমস্টারডাম কেন্দ্রিক জটিল আর্থিক ব্যবস্থা । 


পরিশেষে বলা যায়,  ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটি জাতীয় স্থান লাভ করেছিল। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অফ আমস্টারডাম স্থাপিত হয় , ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অফ হামবুর্গ গড়ে ওঠে । গৌরবময় বিপ্লবের পর ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড গড়ে ওঠে । মূলত এই সময় ব্যক্তিগত ব্যাংকিং -এর দিন শেষ হয়েছিল, শুরু হয়েছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংকিং ও বিনিময় মাধ্যমের যাত্রা । 


Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...