মার্টিন লুথার, ছবির সৌজন্যে : উইকিপিডিয়া
রেনেসাঁস শুধু ইউরোপের মনোজগতেই উত্তরণ করেছিল তা নয় সে স্পর্শ করেছিল ধর্মীয় জগৎকেও এবং প্রশস্ত করেছিল ধর্মসংস্কার বা রিফরমেশনের পথ। এই ধর্মসংস্কার আন্দোলনে একাধিক ব্যক্তিবর্গ যুক্ত ছিলেন, তারা তাদের কৃতকার্যের দ্বারা এই Reformation-কে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাটির লুথার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। মার্টিন লুথার তার ধর্মীয় মতবাদের জন্য অনেকটা ঋণী ছিলেন উইলিয়াম ওকাম নামক এক ব্যক্তির নিকট। এছাড়া তার মতবাদে সেন্ট অগাস্টাইনের প্রভাবও কিছু রয়েছে । লুথার উচ্চশিক্ষা লাভ করে করেন উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে , পরবর্তীকালে তিনি এখানে ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি উইটেনবার্গ চার্চের দরজায় ক্ষমারপত্রের বিরুদ্ধে ৯৫ টি দফা তত্ত্ব ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন ।
এই সময় আধ্যাত্মিক সংকট অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্যাথলিক চার্চের পোপ, বিশপ, আর্চ বিশদ- এরা অত্যন্ত একঘেয়েমি জীবন-যাপন করছিল। পোপ এতটাই বিলাস ভোগী হয়ে উঠেছিলেন যে তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এমন সময় অর্থ সংগ্রহের দাবিতে পোপ ইন্ডালজেন্স / Indulgence বিক্রির কথা চিন্তা করে । পোপের মতে এটি ছিল ক্ষমারপত্র অর্থাৎ পাপ থেকে মুক্তিপত্র যে এই ক্ষমারপত্র কিনবে সে পাপ থেকে মুক্ত হবে এবং স্বর্গ লাভ করবে। আসলে ইন্ডালজেন্স ছিল পোপের লোক ঠকিয়ে অর্থ আদায় করার ফিকির । মূলত ক্যাথলিক চার্চ এই সময় এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল যে ন্যায়-নীতি উপেক্ষা করে বিলাসী জীবনযাপন করতো।
পোপ ইন্ডালজেন্স/Indulgence বিক্রি করার জন্য জার্মানিতে টেটজেন নামক জনৈক ব্যক্তিকে পাঠালে মার্টিন লুথার তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান । প্রকৃতপক্ষে লুথারের কাছে ইন্ডালজেন্স/Indulgence ক্রয়ের বিষয়টি তার মূল ধর্মতত্ত্বের একেবারে বিপরীত । কারণ লুথার বিশ্বাস করতেন মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে কেবলমাত্র ভগবানের প্রতি তার পরিপূর্ণ বিশ্বাসের দ্বারা । লুথারের তত্ত্বে মুক্তির ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তার কোন ভূমিকা ছিল না । 'বন্ডেজ অফ দ্যা উইল' প্রবন্ধে লুথার তার মতামত ব্যাখ্যা করেছিলেন । মানুষ ঈশ্বরের ইচ্ছায় দাস, কাজের দ্বারা মানুষ নিজ অবস্থার উন্নতি হতে পারে না সুতরাং অর্থের বিনিময়ে পাপীকে তার পাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার যে দাবি পোপতন্ত্র তুলেছিল তা লুথারের কাছে মনে হয়েছিল ধর্মের মূল সত্যকে অবহেলা করার এক অসম্ভব প্রয়াস ।
১৫২০ থেকে ১৫২১ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় লুথারের ধর্ম বিষয়ক তিনটি পুস্তিকা । এগুলি হল :
১) An appeal to the Christian nobility of the German nation;
2) A prelude concerning the Babylonian captivity of the church;
3) Of the liberty of Christian man;
এই তিনটি গ্রন্থে বিভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপিত করে লুথার যাজকতন্ত্রের বিরোধিতা করেন। কারণ তার মতে চার্জ ও যাজকতন্ত্র অপ্রয়োজনীয় । ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্মসের ধর্মসভায় পঞ্চম চার্লস লুথারে তত্ত্ব মানতে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয় তার সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অবাধ যাতায়াতের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় ।
লুথার মাতৃভাষায় বাইবেল পাঠের উপর জোর দেন । বাইবেল ছাপার ক্ষেত্রে ছাপাখানার একটা বড় ভুমিকা ছিল। তিনি চার্চকে কোন পৃথক মর্যাদা বা ক্ষমতা দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার এই মনোভাব থেকেই তিনি যাজক কেন্দ্রিক পার্থিব বিষয়ের ওপর আইনগত অধিকারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলতেন- ঈশ্বর বিশ্বাস ও বাইবেলের জ্ঞান লাভের জন্য যাজকতন্ত্রের উপর নির্ভর হওয়ার দরকার নেই , সব খ্রিস্টান নিজেরাই যাজক। তিনি চার্চ বলতে বুঝতেন ভগবানে বিশ্বাসী ভক্তদের সমাবেশ । তাই চার্চ কোনরূপ পৃথক আইনগত অধিকার ভোগ করতে পারে না ।
লুথার তার মতবাদের দ্বারা ব্যবসায়ী শ্রেণিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন । এরা পোপ কর্তৃক আরোপিত একাধিক করকে নিপীড়নমূলক বলে মনে করতেন । অবৈধ ও সীমাহীন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে চার্চ যে বিশাল পরিমাণ স্থাবর আস্তাবর সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করেছিল, এই ব্যবসায়ীরা তা কোনদিনই মেনে নিতে পারেনি। লুথারের মতবাদ তাদের আর্থিক উন্নতিতে সহায়তা করেছিল ।
লুথারের মতবাদ একদিকে যেমন সমকালীন জার্মানি তথা ইউরোপবাসীকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি এই মতাদর্শ অন্তত পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক জীবনে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশে সহায়তা করেছিল । শাসকশ্রেণী লুথারকে সমর্থন করতো । জাতীয় চার্চের ওপর শাসকশ্রেণীর নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে লুথার একদিকে যেমন এদের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিলেন অন্যদিকে তেমনি এদের অত্যাধিক কর্তৃত্বপরাণ পরবর্তীতে সীমাহীন প্রজাতন্ত্রের উদ্ভবের সহায়তা করে। ধর্মীয় বিষয়ে বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন বিপ্লবের বিষয় তিনি বিরোধী ছিলেন । এই কারণেই তিনি জার্মানিতে কৃষকদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি, সামাজিক ও ধর্মীয়ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হওয়া সত্বেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে লুথার ছিলেন মূলত রক্ষণশীল। বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার এবং মহাজনী কারবারকে তিনি কখনোই স্বাগত জানাননি ।
কিছু সীমাবদ্ধতা সত্বেও ষোড়শ শতকে প্রবল প্রতাপশালী পোপেরর একাধিপত্যকে অস্বীকার করা এবং যাজকতন্ত্রের যাবতীয় দুর্নীতি ও অনাচারের তীব্র প্রতিবাদে লুথারের কৃতিত্ব স্মরণীয় । মূলত এর জন্যই পোপ তাকে ধরে এনে শাস্তি নির্দেশ দেন, তবে লুথার ফ্রান্সের সহায়তায় সেখান থেকে পালিয়ে যান । পরবর্তীকালে লুথারের সমর্থকগণ প্রোটেস্টান্ট নামে পরিচিত হন। অর্থাৎ ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট/protest শব্দটি থেকেই প্রোটেস্টান্ট নামের উৎপত্তি।
Comments
Post a Comment