Skip to main content

আজ থেকে প্রায় 150 বছর আগে ভারতের বুকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম আলোকশিখা জ্বলে ওঠে কলকাতার উপকন্ঠে ব্যারাকপুরে | 
1857 সাল | মার্চ মাস শেষ হয় হয় | শীত সবে বিদায় নিয়েছে | সকালের দিকে এখনও হিমের পরশ | কিছু দূরেই কুল কুল করে বয়ে চলেছে পতিত পাবনী গঙ্গা | 
কলকাতার উপকন্ঠে ব্যারাকপুরের এই ক্যান্টনমেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান ঘাঁটি | এখান থেকেই বিদ্রোহের ধ্বজা আকাশের বুকে উড়েছিল | মঙ্গল পান্ডে নামের এক সামান্য সিপাই তাঁর হাতের বন্দুক থেকে নিক্ষেপ করেছিলেন মহাবিদ্রোহের প্রথম গুলিটি |
মঙ্গল পান্ডের ছেলেবেলা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না | তবে তিনি ছিলেন উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার গোঁড়া এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান | উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের অন্তর্গত আকবরপুর তহশীলে 1827 সালের 19শে জুলাই মহাবিদ্রোহের অগ্নিশিখা মঙ্গল পান্ডে জন্ম গ্রহণ করেন | তাঁর পিতার নাম ছিল দিবাকর পান্ডে | মঙ্গলের একটি বোন ছিল | 1830 সালে এক দূর্ভিক্ষে তার অকাল মৃত্যুহয় | দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত পান্ডে পরিবার বাধ্য হয়ে কিশোর মঙ্গলকে ইংরেজদের সেনা ছাঁউনিতে পাঠিয়েছিল | ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মিতে যোগ দিলেন মঙ্গল পান্ডে, হলেন নেটিভ ইনফ্যানট্রি রেজিমেন্টের সিপাই, কোম্পানি নং 5, রেজিমেন্ট নম্বর 34 এবং নিজের নম্বর 1446 | 
পুজো আচ্চা আর ধ্যানে বেশ খানিকটা সময় ব্যয় করেন পান্ডেজী | ব্যারাকপুরের ছাঁউনিতে এমন একজনও সিপাই ছিল না যারা পান্ডেজীকে শ্রদ্ধা করে না, ভালোবাসে না | নিজে ধর্মভীরু হলেও ইসলাম বা অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর পুরো শ্রদ্ধা ছিল | তাই তাঁকে পছন্দ করার ব্যাপারে জাতি বা ধর্ম কোনো গন্ডি টানতে পারেনি | 
এবার আসা যাক 1857 সালের 29শে মার্চ সেই ঘটনাবহুল মুহূর্তে | দীর্ঘ দিন ধরে নানা কারণে সিপাইদের মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে | প্রতি মুহূর্তে তাদের দাঁড়াতে হচ্ছে অন্যায় অবিচারের সামনে | নেটিভ বা কালো আদমি বলে সহ্য করতে হচ্ছে অবর্ণনীয় অপমান | কিন্তু এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন এমন মানুষ কোথায় | এই অবস্থায় এগিয়ে এলেন ছাব্বিশের যুবক মঙ্গল | তখনকার দিনে 53 এনফিল্ড রাইফেলের টোটার সামনের অংশ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে বন্দুকে বারুদ ভরতে হত | পান্ডেজী খবর পেয়েছেন গরু আর শুয়োরের চর্বি মাখানো আছে ঐ টোটায় | সেই টোটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে বাধ্য হচ্ছেন জাতিধর্ম নির্বিশেষে | জাতি ও ধর্ম খোয়াচ্ছেন হিন্দু ও মুসলমানরা | 
ইংরেজদের ওপর রাগ এবং অপরিসীম বিদ্বেষ ধুমায়িত হচ্ছে সিপাইদের মধ্যে | উভয় সম্প্রদায়ের লোক অপেক্ষা করে আছেন পান্ডেজীর মতামতের উপর | 
অবশেষে 1857 সালের 29শে মার্চ ছাঁউনিতে সিপাইরা তৈরি হচ্ছে আর একটি নূতন দিনের কাজ শুরু করার জন্যে | সার্জেন্ট মেজর হিউসন একটু আগে ঘোড়া ছুটিয়ে সেখান দিয়ে গেছেন |তিনি একা নন, সঙ্গে আরও অনেক ইংরেজ সামরিক অফিসার | সেদিন যে সব সিপাই পান্ডেজীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তারা ফেরার পথে বলাবলি করছিল ইংরেজ সামরিক বাহিনীর অফিসাররা আজ পান্ডেজী কে স্যুটিং রেঞ্জে নিয়ে যাবে | বাধ্য করবে দাঁত দিয়ে গরুর চর্বি মাখানো টোটা ছিঁড়তে |
সেই নির্মল প্রভাতে কেউ ভাবতেও পারেনি বৃটিশ কোম্পানির ভারত শাসনের সূর্য অস্তমিত হওয়ার সূচনা হবে ব্যারাকপুরের ঐ ছাউনিতেই , শুরু হবে দিন গোনার পালা, শুরু হবে ভারত মাতার এক বীর সৈনিকের আত্মবলিদানের কাহিনি | 
এখনও বিউগল বাজেনি | ব্যারাকে ব্যারাকে তৈরি হচ্ছে সিপাইরা | হঠাৎ সামনের প্যারেড মাঠে ছুটে এলেন ক্ষিপ্তপ্রায় এক সৈনিক | দৃপ্ত ভঙ্গিতে বন্দুক উঁচু করে ধরে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, "ভাই সব আর চুপ করে বসে থেক না | ভগবানের দোহাই তোমরা বেরিয়ে এস | গুলি করে মেরে ফেল ফিরিঙ্গী শয়তানদের | " যিনি এই আদেশ করেছেন তিনি আর কেউ নন স্বয়ং মঙ্গল পান্ডে | সার্জেন্ট মেজর হিউসন সেখান দিয়ে ফিরছিলেন | তিনি এই দৃশ্য দেখে সামনের ব্যারাকের দেশি সিপাইদের আদেশ দিলেন গ্রেপ্তার করো ওকে ....অ্যারেস্ট হিম | হিউসন অবাক হয়ে দেখলেন একজন সিপাইও তাঁর আদেশ পালন করতে এগিয়ে এল না! কোন উপায় না দেখে তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে পান্ডেজীর কাছে যাবার চেষ্টা করলেন, তার আগেই পান্ডেজীর হাতের বন্দুক টা গর্জে উঠল | হিউসনের বুকে এসে লাগল সেই গুলি | সেখানেই ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন সার্জেন্ট মেজর হিউসন | 
গোলমাল কানে গিয়েছিল লেফটেনেন্ট বাফের | তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে ছাঁউনির দিকে আসতেই মঙ্গল পান্ডের বন্দুক থেকে ছুটে গেল আর একটা গুলি | বাফের গায়ে না লেগে গুলিটা লাগল ঘোড়ার পেটে | পান্ডেজীর বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল | কোমর থেকে তলোয়ারটা টেনে নিয়ে মঙ্গল পান্ডে ছুটলেন বাফের দিকে | বাফ গুলি চালানোর আগেই পান্ডেজী ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাফের ওপর | 
এতক্ষণে খবর পৌঁছে যায় ইংরেজ ডেরায় | ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে এলেন কর্নেল হুইলার | পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ছুটিয়ে চলে গেলেন ইউরোপীয় সেনাদের ছাউনির দিকে | তাদের আদেশ দিলেন, মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করতে | ইউরোপীয় সেনারা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঘিরে ফেলল মঙ্গল পান্ডেকে | পান্ডেজী বুঝলেন তিনি একা অতগুলো গোরা সেনার সঙ্গে পেরে উঠবেন না | ততক্ষণে তিনি বন্দুকে গুলি ভরে নিয়েছেন | বন্দুক নিজ বুকে রেখে গুলি চালিয়ে দিলেন | কিন্তু তাঁর দূর্ভাগ্য গুলিটা তাঁর হ্রদপিন্ডে না লেগে অন্যদিকে লাগল | রক্তাক্ত মঙ্গল পান্ডে পড়ে রইলেন | কিন্তু মারা গেলেন না | ধরা পড়লেন ইংরেজদের হাতে | 
1857 সালের 6ই এপ্রিল সামরিক আদালতে মঙ্গল পান্ডের বিচারসভা বসে | কর্নেল হুইলার এলেন সাক্ষী দিতে | সামরিক আদালতের বিচারে মঙ্গম পান্ডে দোষী সাব্যস্ত হলেন | তাঁর ফাঁসির হুকুম হল | দেখতে দেখতে এসে গেল নির্দ্ধারিত দিন 1857 সালের 8ই এপ্রিল | ভোর সাড়ে পাঁচটায় ব্রিগেড প্যারেড ফাঁসি দেওয়া হল স্বাধীনতার সূর্য মঙ্গল পান্ডেকে | তাঁর রুগ্ন ঝুলন্ত শরীরটা অনেকক্ষণ রাখা হয়েছিল খোলা আকাশের নীচে যাতে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে অন্য সিপাইরা বিদ্রোহী হবার সাহস না করে |
(Papai Sikder)

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...