Skip to main content

নদীয়া জেলা ও তার রাজবংশের ইতিহাস



নদীয়ার রাজবংশের ইতিহাস :::----
বাংলা বিজয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার স্বরুপ ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সন্মান লাভ করেন এবং তার সাথে এক ফরমান দ্বারা নদীয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ,মহৎপুর,লেপা,কাশিমপ​ুর, কয়েশা মমুন্দ্রা প্রভৃতি চৌদ্দটি পরগনার অধিকার লাভ করেন ( 1606 খ্রি : ) | মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রদত্ত 14 টি পরগনার সনদসূত্রে নদীয়ার রাজা হন ভবানন্দ মজুমদার এবং সেই সঙ্গেই নদী
য়া রাজবংশের সূচনা করেন | তাঁর বংশধররা 'রাজা' উপাধি ধারণ করে
ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদীয়া শাসন করেন | ভবানন্দের পূর্ব নাম ছিল দূর্গাদাস সমাদ্দার, কিন্তু নদীয়া রাজপদে আসীন কালে তার নাম হয় ভবানন্দ মজুমদার |

ভবানন্দের পূর্বপুরুষের পরিচয় :--

নদীয়ার রাজাগণ আদিশূর আনীত পঞ্চব্রাহ্মণের অন্যতম নেতা ভট্টনারায়ণের বংশজ | ভট্টনারায়ণ কান্যকুব্জ প্রদেশের ক্ষিতীশ নামে এক রাজার পুত্র ছিলেন | ভট্টনারায়ণের পুত্র নিপু হইতে অধঃস্তন একাদশ পুরুষে কামদেব জন্মগ্রহণ করেন | এই কামদেবের চার পুত্র ছিল তার মধ্যে জেষ্ঠ্য বিশ্বনাথ পিতার পিতৃগদী প্রাপ্ত হয়ে 1400 খ্রিস্টাব্দে দিল্লী যাত্রা করেন এবং স্বকীয় অসাধারণ বিদ্বাবত্ত্বাগুণে দিল্লির দরবার হতে রাজ উপাধি এবং পৈত্রিক সম্পত্তি ব্যতীত আরও অনেক গুলি গ্রামের অধিকার পান | বিশ্বনাথের পরে উল্লেখযোগ্য রাজা হন কাশীনাথ | ইনি অসাধারণ বীর এবং বুদ্ধিমান হলেও শেষপর্যন্ত এক ঘাতকদের হাতে প্রাণদান করেন | এই সময় তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী বাগোয়ান পরগনার জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্বারের বাড়িতে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন | সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন | এই পুত্রের নাম রামচন্দ্র | অন্যদিকে জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্বার ছিলেন নিঃসন্তান , তাই মৃত্যুকালে তিনি রামচন্দ্রকেই তাঁর ক্ষুদ্র জমিদারীর অধিকারী করে যান | আর এই রামচন্দ্রের দূর্গাদাস, জগদীশ, হরিবল্লভ এবং সুবুদ্ধি নামে চারটি পুত্র ছিল |

এই দূর্গাদাসই পরে " মহারাজা ভবানন্দ মজুমদার " নামে অভিহিত হন | জানা যায়, বঙ্গের শেষ স্বাধীন বাঙ্গালী রাজা প্রতাপের রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীর এর সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন | তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে 1606 খ্রিস্টাব্দে ভবানন্দকে 14 টি পরগনা সনদসূত্রে দেন | এছাড়াও 1608 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁকে কানুনগুই পদে নিযুক্ত করেন | এমনকি দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনন্দ ও মজুমদার উপাধিও এনে দেন |

ভবানন্দ নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে নদীয়ারাজের রাজধানী স্থাপন করেন | পরবর্তীতে নদীয়ারাজ রুদ্র রায় তাঁর তৎকালীন নদীয়া রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ ' 'রেউই ' গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং রেউই এর নামকরণ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে ' কৃষ্ণনগর ' |

রাজা রুদ্র রায় অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন | দিল্লীর সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, খাড়ি, জুড়ি ইত্যাদি কয়েকটি পরগনা দান করেন | তিনি সম্রাটের সহায়তায় সনিপুণ স্থপতিদের এনে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কাছারি, কেল্লা, পূজোর দালান, নাচঘর, চক, নহবৎখানা প্রভৃতি নির্মাণ করেন |

নদীয়ার রাজাদের রাজত্বকাল ::----

ভবানন্দ মজুমদার -- 1606-1628
গোপাল রায় -- 1628-1632
রাঘব রায় -- 1632-1883
রুদ্র রায় -- 1683-1694
রামকৃষ্ণ -- 1694 ( অল্প সময়ের জন্য)
রামজীবন -- 1694-1715
রঘুরাম -- 1715-1728
কৃষ্ণচন্দ্র - 1728-1782
শিবচন্দ্র -1782-1788
ঈশ্বরচন্দ্র - 1788-1802
গিরীজচন্দ্র - 1802-1842
শ্রীশচন্দ্র -1842-1856
সতীশচন্দ্র -1856-1870

কৃষ্ণচন্দ্র :-- নদীয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় | মাত্র 18 বছর বয়সে 1728 খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা হন | তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যে বিস্তার ঘটে | তাঁর সময় পরগনার সংখ্যা ছিল 84 টি এবং রাজ্যের পরিধি ছিল 3850 ক্রোশ | নদীয়া জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন মি. এফ রেডফার্ণ তারই রাজত্বকালে | তাঁর রাজত্ব কাল নানা ঘটনায় পূর্ণ ছিল | পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর , বর্গী হামলা ইত্যাদি তারই আমলে হয় | সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্র কে প্রথম ' মহারাজা ' ও পরে ' মহারাজেন্দ্র বাহাদুর ' উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সঙ্গে পতাকা, নাকড়া ঝালদার পালকি ইত্যাদি রাজ পুরষ্কার প্রদান করেন | মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পূর্ণ রাজ উপাধিটি ছিল এই রকম -- " অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমন মহারাজরাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় " | কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই নদীয়া সর্বাধিক উন্নতি লাভ করে | তিনি সারা নদীয়া জুড়ে অনেক দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন | তাঁর আমলেই কৃষ্ণনগর রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষ বা বিষ্ণুমহল এবং পঙ্খের কারুকাজ সমন্বিত নাট মন্দির নির্মাণ করা হয় | লর্ড ক্লাইভ কৃষ্ণচন্দ্র কি রাজেন্দ্র বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন |
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে আছেন যোদ্ধার সাজে মৃণ্ময়ী মূর্তি বা রাজ - রাজেশ্বরী ' নামে খ্যাত তাঁর জাঁক জমকপূর্ণ পূজো - উৎসবের জন্যেও |

সর্বপরি 1782 খ্রিস্টাব্দে 73 বছর বয়সে কৃষ্ণনগরের অদূরে অলকানন্দার তীরে কৃষ্ণচন্দ্র দেহত্যাগ করেন | মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয়া রানির পুত্র শিবচন্দ্র রাজা হন | বর্তমানে এই রাজবংশের কেউ কৃষ্ণনগর থাকেন না | তাঁরা কলকাতার ' নদীয়া হাউসে ' র বাড়িতে থাকেন |

তথ্যসূত্র ::- নদীয়া কাহিনী
নদীয়ার কথা

Comments

Popular posts from this blog

আদি সমাজতন্ত্র বাদী বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র লেখক- সুমন্ত ঘোষ

সমাজতন্ত্রবাদ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক মতবাদ শিল্প বিপ্লবের প্রসারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে কয়েকজন খ্যাতনামা সমাজতান্ত্রিক এর আবির্ভাব হয় । এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে সকলেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম থেকে পাওয়া আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টন করা হবে। মূলত এই মতবাদ প্রচলিত গণতন্ত্রবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে যৌথ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এর ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ নির্দেশ করে সেটাই সমাজতন্ত্রবাদ । সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে তত্ত্বগত মতভেদ আছে। মাক্স পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রবাদীদের আদি সমাজতন্ত্র বাদী বলা হয়। যাদের utopian বা অবাস্তব আদর্শবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ম্যানচেস্টারের একটি কাপড়ের কলের ম্যানেজার। ম্যানেজার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু factory প্রথার যাবতীয় কুফল দেখে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি সাধনে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। নিউ ল্যানার্কে একটি আদর্শ শিল্পনগর স্থাপন করে শ্রমিক সাধারণের সর্বপ্রক...

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে শর্ট প্রশ্ন

১   ) হিট্রো - গ্রাফি   কথার   অর্থ   কি                                                                         উত্তরঃইতিহাস   চর্চা ২ )  ইতিহাসের   জনক কাকে বলে                                                                        উত্তরঃহেরোডোটাস ...

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতটা 'বৈপ্লবিক' ছিল? লেখক: সুমন্ত ঘোষ

ইউরোপের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যে কত দূর পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূলত এই সময় মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধিতসা সত্বেও বিজ্ঞানচেতনা যে সবক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিল তা বলতে একটু দ্বিধা বোধ হয়। কারণ এইসময় বৈজ্ঞানিকগন জগৎ ও বিশ্বভ্রম্মান্ড নিয়ে আলোচনা করলেও তারা সেগুলির যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অনেক সময় অক্ষম হতেন। তবে উল্লেখ করা দরকার গ্যালিলিও, কোরারনিকাস- এ সম্বন্ধে কিছু যুক্তি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে অবশ্যই সক্ষম হয়েছিলেন।  বৈজ্ঞানিক বিপ্লব 'বৈপ্লবিক' পর্যায়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা বাধা লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হলো বৈজ্ঞানিকগণের অনেকাংশই জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করত। তারা মনে করত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল প্রায় সমর্থক। মূলত এই ধারণাই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বৈপ্লবিক ধারায় রূপান্তরের পরিপন্থী ছিল। তবে এক্ষেত্রে আমরা একজন ব্যতিক্রমী মনীষীকেউ দেখতে পারি যিনি তার আবহাওয়া সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা এই ভ্রান্ত জ্ঞান অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন। ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন রেনেসাঁ...